আগেই উল্লেখ করেছি, আমার বাড়ি পাবনা শহর থেকে দুরে অবস্থিত হওয়ায় আমি বাহাদুরপুর গোপালপুরে জায়গির থাকতাম। আমার বাড়ি বাঙ্গাবাড়িয়া-বাদলপাড়া থেকে গোপালপুর যাবার পথ-ঘাটের বর্ণনা দেওয়াই সুকঠিন। কারণ আমার বাড়ির পালানে নামলেই জমির আইল পথ।
সড়ক বা রাস্তা বলতে যা বুঝায় তার কিছুই ছিলোনা। গাঁও-গেরামের মধ্য দিয়ে হালট বা ডহর নামে যে সরকারি রাস্তা তার কোনটাই ঠিক ছিলোনা। সেই রাস্তায় কেবল গরু-মহিষের গাড়ি চলাচলের কারণে তাকে গাড়ির নিরিখ বলা হতো। যাকে বলে খানা-খন্দক। বাড়ি থেকে বের হবার পর জমির আইল পথ ধরে চলতে হতো। কো কোন জমির মধ্যখান দিয়ে পথ।
জনগণের চলাচলের সুবিধার জন্য আইলের ঘোরা পথের বদলে এই পথ। কোন কোন জমির মালিক আবার এটা পছন্দ করতোনা, তাই সেই পথে খেজুর, বাবলা, ডেফল কিংবা আগুন জ¦লা গাছের কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। ওই
পথে চলতে গিয়ে স্পঞ্জের ফিতা ছিঁড়ে যেতো। তাই মোটর গাড়ির টায়ারের সেন্ডেল যার নাম ছিলো অক্ষয় কেম্পানির চটি, তাই পায়ে দিয়ে
চলতে হতো। কেউ কেউ আবার খড়ম পায়ে দিয়ে পথ চলতো। তবে অধিকাংশই খালি পায়ে চলাফেরা করতে ভালো বাসতো।
একবার আমি জায়গির বাড়ি যাবার পথে রূপপুর ও ঘরনাগড়া গ্রামের লোকদের নিকট জানতে পারি যে, এলাকার আখ ক্ষেতের আখ শেয়ালে কামড়িয়ে রস চুষে নিয়ে দারুন ক্ষতি করছে। এলাকার কৃষকদের প্রধান ফসল হলো আখ। পরিপক্ক আখ কলে মাড়াই করে তা থেকে প্রথমে রস এবং সেই রস থেকে গুড় তৈরি করে বিক্রয়ের মাধ্যমে সংসারের খরচ-পাতি চালায়।
তাই অনেকে শিয়ালের হাত থেকে আখ রক্ষার জন্য রাত জেগে পাহারা দেয়।
এই ঘটনা আমার মনে বেশ দাগ কাটে। মনে মনে ভাবি এলাকার কৃষকদের সার্থ রক্ষায় এটাতো একটা খবর হয়। তাই দীর্ঘ সময় ধরে সাজিয়ে-গুছিয়ে একটি খবর লিখে ফেলি। প্রথমে কাঠ পেন্সিল দিয়ে
লিখি। তারপর তা কাটা-কুটা করে ফ্রেস করে ফাউন্টেন পেন বা ঝরণা কলাম দা¦রা লিখে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল হামিদ টিকে
স্যারের নিকট নিয়ে যাই। হামিদ স্যার খবরটি মনোযোগসহকারে পড়ে একটু মৃদু হেসে আমার লেখা খবর শুধরে দিলেন। অর্থাৎ আমি লিখেছিলাম, ‘পাবনা সদর মহকুমার মালিগাছা
ইউনিয়নের রূপপুর ও ঘরনাগড়া গ্রামের হাজার হাজার বিঘা জমির আখ
শিয়ালে খাইয়া ফেলিতেছে। শিয়াল কর্তৃক আখ খাইয়া ফেলায় কৃষকেরা
দিশাহারা হইয়া পড়িতেছে। তাহারা কি করিবে তাহা কিছুই ভাবিয়া ঠাহর করিতে পারিতেছেনা। এলাকার শিয়ালগণ দল বাঁধিয়া একজোট হইয়া আখ ক্ষেতের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আখ কামড়াইয়া কামড়াইয়া রস
চুষিয়া লওয়ায় আখের গাছ শুকাইয়া মরিয়া যাইতেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিনি আমার সামনেই খবরটি শুধরিয়ে দিলে আমি তখন বুঝতে পারি যে, আমার লেখায় বহু সংখ্যক ভুল রয়েছে। আমি বুঝতে পারি যে, শিয়াল আখ খেয়ে ফেলতে পারেনা। শুধু রস চুষে নেয়। এছাড়া যখন লেখা হয়েছে
দল বেঁধে তখন আর একজোট হয়ে লেখার কোন প্রয়োজন ছিলোনা।
আবার হাজার হাজার বিঘা জমির পরিবর্তে এলাকার অধিকাংশ আখের
জমি লেখা উচিত ছিলো। এমনি ভুলের জন্য আমি নিজে নিজে লজ্জা
পাই এবং সেদিনের রিপোর্টটির কথা মনে হলে এখনো আমার হাসি পায়।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। কোন এক উদীয়মান
কবি কয়েক লাইন কবিতা লিখে একজন প্রতিষ্ঠিত কবির নিকট নিয়ে
গিয়ে একটু সংশোধন করে দিতে বলেন। কবিতাটির প্রথম লাইন ছিলো: কপাল ভিজিয়া গেলো/ দু নয়নের জলে।’ এর পরের লাইন মিলাতে
পারেননি। তখন প্রতিষ্ঠিত কবি তার উৎসাহ যাতে নষ্ট না হয় তাই
তিনি আরেক লাইন লিখে দিলেন, যা দাঁড়ায় ‘‘ কপাল ভিজিয়া গেলো /দু নয়নের জলে। কবিকে উব্দা করে ঝুলাও আ¤্র গাছের ডালে।’’ অর্থাৎ
কপালের স্থলে কপোল লিখলেই কেবল চোখের জল গন্ড বেয়ে পড়তো।’’ আমার দশাও যেন তাই। যাক সেকথা। ১৯৬৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে সর্বপ্রথম বাংলা অনার্স বিভাগ চালু হয়। আমি বাংলা অনার্সে ভর্তি হই। মোট ১২ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ক্লাশ শুরু হয়। কিন্তু বেশি দিন আর কলেজে পড়া সম্ভব হয়না। হঠাৎ করেই পাবনা কালেক্টরেটের অধীনে রাজস্ব বিভাগে চাকরি হওয়ায় আমি এবছর ২২ এপ্রিল সরকারি চাকরিতে যোগদান করি। ফলে লেখা-লেখির অধ্যায় চালু থাকলেও সাংবাদিকতা করার সখ একেবারেই উবে যায়।
এরই মাঝে একটি অযাচিত ঘটনা ঘটে যায়। পাকিস্তান সরকার আমাদের ৬শ জনকে চাকরি থেকে বিনা কারণে ছাঁটাই করে, এবং ১৯৭১
সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরকারি দপ্তরের সকল চার্জ বুঝে দিবার জন্য
টেলিগ্রামে আদেশ দেয়। টেলিগ্রাম পাবার পর নির্ধারিত তারিখে অফিসের চার্জ বুঝে দিয়ে দারুণ মনোকষ্ট নিয়ে বাড়ি চলে আসি।
কে জানে এটাই আমার জন্য সাপে বর হবে।
আমি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়ণের সময় ১৯৬৮ সালে ছাত্রলীগের
প্যানেলে এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বার্ষিকী সম্পাদকের পদে প্রতিদন্বিতা করি। সেসময় মোহাম্মদ নাসিম, ফজলুর
রহমান পটল, সোহরাব উদ্দিন সোবা, আব্দুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম
বকুলসহ ছাত্র লীগের নেতাদের সঙ্গে আমার সখ্যতা ছিলো।
আর এসময় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে ১ মার্চ হতে সারা দেশ তখন আন্দোলনে উত্তাল। আমিও তখন সেই আন্দোলনে যোগ দেই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য মহান মুক্তি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি।
দীর্ঘ নয় মাস একটানা যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তখন মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ ঘোষণা করেন যে, যেসকল সরকারি চাকুরে মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা যে যেখানে অর্থাৎ যে থানায় অবস্থান করছেন তারা সেখানেই যোগদান পত্র দাখিল করবেন। আামদের মুক্তিযোদ্ধার দলসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাগণ মিলে ১৫ ডিসেম্বর শাহজাদপুর থানার
বাঘাবাড়িতে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে এলাকা শত্রু মুক্ত করে।
পরদিন আমরা শাহজাদপুরের বিভিন্ন স্কুল কলেজ এবং শাহজাদপুর ঠাকুর
বাবুর কাচারি বাড়িতে (বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের কাচারি বাড়ি) ক্যাম্প স্থাপন করে সিভিল প্রশাসনের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন।
কমান্ডার আব্দুল মতিন মোহনের নেতৃত্বে তার গ্রুপের টুআইসি হিসেবে আমি শাহজাদপুর কলেজ ক্যাম্পে অবস্থান করতে থাকি এবং
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শাহজাদপুর সার্কেল অফিসার রেভিনিউ এর
অফিসে যোগদান পত্র দাখিল করি। সিও রাজস্ব গোলাম কিবরিয়া আমার
চাকরির অতীত বিষয়াদি না জেনেই আমার যেগদান পত্র গ্রহণ করেন এবং
ডিসেম্বর মাসের বেতন ও ঈদের অগ্রিম বোনাস প্রদান করেন।
কিছুদিন পর পাবনা জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করায় তিনি তা গ্রহণ করেন এবং আমাকে চাকুরিতে পুনর্বহাল করেন। সেই সঙ্গে
পুর্বের চাকরিও সাভিস বুকে যোগ করার অনুমতি প্রদান করেন, যা পরবর্তীতে ২য় শ্রেণির পদমর্যাদায় পদোন্নতি পেতে আমাকে কোন
বেগ পেতে হয়নি।
সে যাক। শাহজাদপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান কালে শাহজাদপুর পারকোলা গ্রামের যুবক সাইফুদ্দিন আহমদ ( রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সাবেক পরিচালক ড.
সাইফুদ্দিন আহমদ) ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে “গণবাংলা’’
নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং আমাকে উক্ত পত্রিকার প্রধান
উপদেষ্টা করেন। প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহজাদপুর পোতাজিয়ার আব্দুল মতিন মোহন এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক
ছিলেন শাহজাদপুরের এম সি এ আব্দুর রহমান। পত্রিকাটি শাহজাদপুর
দ্বারিয়াপুর বাজারের আজাদ প্রেস হতে মুদ্রিত হয়ে মনিরামপুর বাজার
থেকে প্রকাশিত হতো। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১ ঊসধরষ: বনধফধঃধষর ১৯৭১ @ মসধরষ .পড়স তারিখ: ২৫
/১০ /২০২০.