করোনা কালের জীবন ধারা ৭৭

‘ধর্ষণ’ এক ধরণের যৌন আক্রমণ। সাধারণত, একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যাতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোন ধরণের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে। ভয়াবহ মহামারি, আন্তর্জাতিক সংঘাত বা যুদ্ধের সময় নিয়মতান্ত্রিকভাবেও ব্যাপক হারে ধর্ষণ (যুদ্ধকালীন সহিংসতা ও যৌন দাসত্ব) ঘটতে পারে।
আমাদের বাংলাদেশের মাটিতে যেমনটি ঘটেছিলো ১৯৭১ সালে। যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিতে বাংলাদেশের নীরিহ- নিরপরাধ মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার শুরু করে। তারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা, লুঠ-তরাজ, অগ্নিসংযোগ করতে থাকে, তখন এদেশীয় কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম রক্ষার দোহাই দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের দোসর হিসেবে কাজ করে। তাদের মাধ্যমে তখন এদেশের মা বোনের ইজ্জতের ওপর আঘাত হানা হয়। যা ছিলো অবর্ননীয় ধর্ষণ লীলা। এধরণের ঘটনাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে পাকিস্তানিদের সেইসব দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের বিচারও করা হয়। বেশ কয়েকজনকে মৃত্যুদন্ডসহ আমৃত্যু কারাদন্ডে দন্ডিত করে তা কার্যকর করা হয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে কোন হানাহানি নেই, নেই সহিংসতা। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘ দিন ধরে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। কিন্তু অতিমারি করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের মানবিক গুনাবলীতে কিছুটা হলেও চিড় ধরেছে। তা না হলে সৃষ্টি কুলের সর্ব শ্রেষ্ঠ প্রাণির দ্বারা পশুর মত জঘন্য আচরণ কিভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তা ভাবতেও অবাক লাগে।
প্রতিটা ধর্ষণের পর সমাজের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মতের ব্যখা দিয়ে থাকেন। একদল নারীর পোষাক-আশাক ও চলা-ফেরার প্রতি দোষারোপ করেন। কেউ কেউ আবার নরীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে জিহ্বায় জল আসার কথাও বলেন। অন্য দল ধর্ষকের বিকৃত মানসিকতার প্রতি দোষারোপ করেন। তাহলে এ প্রশ্ন মনে উদয় হতেই পারে যদি নারীর পোষাক-আশাক ও চলাফেরাই ধর্ষনের কারণ হয় তাহলে তিন বছরের শিশু, ছয় বছরের বালিকা কেন ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণকারীদের বিকৃত মানসিকতা না হলে শিশু-কিশোর বয়সের বালকেরা কেন বলাৎকারের শিকার হয়।
হঠাৎ করে ব্যাপক হারে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎকন্ঠা তৈরি হয়েছে নাগরিক সমাজে। সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিমারি মারণব্যাধি করোনাভাইরাসের প্রদুর্ভাবের সময় বেপরোয়া ধর্ষণের কারণ হচ্ছে, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। দুষ্টচক্রের রাহুগ্রাস সর্ব্বোচ্য বেড়ে যাওয়ার কারণে অপরাধীরা বেপরোয়া অবস্থান নিয়েছে। অতি সম্প্রতি ব্যাপক হারে ধর্ষণের ঘটনাগুলোর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধর্ষণকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ না থাকায় নির্দ্ধিধায় তারা ধর্ষণ করতে উদ্যোগী হচ্ছে।
প্রযুক্তির অপব্যাবহারের ফলে দেশে ধর্ষণ বেড়ে চলেছে বলে অনেকেই মতামত ব্যক্ত করেছেন। করোনাকালে আমাদের সমাজে পারিবারিক বন্ধন কমে যাওয়া, সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ববোধের অভাব এবং খারাপ সঙ্গ, ধর্ষণের মত সামাজিক অপরাধ বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রযুক্তির সহজ লভ্যতা ও অপব্যবহারের কারণে ফেসবুক, ইউটিউবে অবাধে পর্ণগ্রাফী দেখে অনেক পুরুষ ধর্ষণে উৎসাহিত বোধ করছে। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে দেশে পর্ণোগ্রাফি-সংক্রান্ত আইন তৈরি হলেও কোড অব কন্ডাক্ট, ইন্টারনেট কারা ব্যবহার করবে এবং এর নজরদারির বিষয়গুলো সঠিকভাবে মানা হচ্ছেনা।
পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইড) এব্যাপারে ভালো কিছু কাজ করলেও এ সংস্থাকে ধর্ষণ ও সামজিক অপরাধ প্রতিরোধে আরও কাজ করতে হবে। এছাড়া এধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অপরাধীকে দ্রুত কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন।
নোয়াখালী বেগমগঞ্জে ঘরের ভিতরে ঢুকে বিবস্ত্র করে এক নারীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ চেষ্টার ৩২ দিন পর এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এবং এর আগে সিলেটের এমসি কলেজে এক গৃহবধুকে তার স্বামীর সামনে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করার পর সারা দেশে এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শুরু হয় আন্দোলন। পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পর ফাঁসির দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা, উপজেলায় তীব্র আন্দোলন গড় তুলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
এই আন্দোলন চলার মধ্যে বেগমগঞ্জের ঘটনার ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও শিশু বলাৎকারের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার খবর প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্যাপকহারে প্রকাশ পাচ্ছে। দৈনিক প্রথম আলো গত ৭ অক্টোবর-২০২০ এর খবরে জানা যায়, সারা দেশে এখন নারীদের ওপর এত নির্যাতনের ঘটনায় সরকার পর্যন্ত বিব্রত বলে মন্তব্য করেছেন দেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘ সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত বলেছেন আমরা ক্ষমতায়, আমরা এর দায় এড়াতে পারিনা। আমরা জুডিশিয়ারিতে আছি, আমরাও চাই উপযুক্ত বিচার হোক।’ সদ্য প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের স্মরণে আয়োজিত শোক সভায় তিনি একথা বলেন।’
বাংলাদেশে অব্যাহত ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার মামলাগুলো দ্রুত বিচারে আইন সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। সিলেট ও নোয়াখালীতে দুই নারীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান। (বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম, ৭ অক্টোবর-২০২০)।
আশার কথা এই যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদন্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধনী আনার উদ্যোগী ভুমিকা নিয়ে আইন সংশোধন করে ধর্ষকের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদন্ডের বিধান করেছেন। এব্যাপারে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। নতুন এই অধ্যাদেশ জারির পর টাংগাইলে মাদরাসা ছাত্রী ধর্ষণের অপরাধে গত ১৫ অক্টোবর-২০২০ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৫ জনকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বিশে^র বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের সর্ব্বোচ্য শাস্তি দেওয়া হয় দ্রুততম সময়ে। বিভিন্ন দেশের কিছু আইন নি¤েœ তুলে ধরা হলো। আরব আমিরাতে ৭ দিনের মধ্যে মৃত্যুদন্ড। সৌদি আরবে প্রকাশ্যে মৃত্যুদন্ড। উত্তর কোরিয়ায় ফায়ারিং সেকায়াডে গুলি। আফগানিস্তানে ৪ দিনের মধ্যে গুলি বা ফাঁসি। মিসরে ফাঁসি। ইরানে প্রকাশ্যে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদন্ড অথবা ফাঁসি। যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ আমৃত্যু কারাদন্ড। ভারতে ১০-১৪ রছর কারাদন্ড, বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড। মঙ্গোলিয়া- ধর্ষিতার পরিবারের হাত দিয়ে ধর্ষককে মৃত্যুদন্ড এবং গ্রিসে ধর্ষণের শাস্তি হলো আগুনে পুড়িয়ে মারা। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন পাশ করেছে নাইজেরিয়ার কাদুনা রাজ্য। সেখানে কোন ব্যক্তি ধর্ষণ করলে তাকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খোজা করে দেওয়া হয়। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১ ঊসধরষ: বনধফধঃধষর ১৯৭১ @ মসধরষ .পড়স তারিখ: ১৮ /১০ /২০২০.