যে যাই বলুকনা কেন করোনাভাইরাসের গতি নি¤œমুখি। আক্রান্তের চেয়ে সুস্থ্যতার হার বেশি। বিশ^ ব্যাপি অতিমারি এই করোনাভাইরাস এবছরের প্রথম থেকে আক্রমণ শুরু করে। চীনের উহান থেকে এর উৎপত্তি। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ-২০২০ তিন ব্যক্তির শরীরে এর লক্ষণ প্রকাশ পায় অর্থাৎ করোনাভাইরাসের রোগী প্রথম সনাক্ত হয়। মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ তারিখে। করোনাভাইরাস যেন দেশ ব্যাপি ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী পালনের জোর প্রস্তুতি চলছিলো সেসময়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দুরদর্শী চিন্তা এবং ত্যাগি মনোভাবের কারণে তিনি তার পিতার জন্ম শত বার্ষিকীর সকল সরব আয়োজন বন্ধ করে সাধারণ মানুষকে করোনার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ব্রতি হন। তিনি ২৬ মার্চ থেকে সকল সরকারি বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করেন। সারা দেশের সকল প্রকার দোকান-পাট যান-বাহন, শিক্ষা প্রষ্ঠিানসহ সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। দেশ গোটা লকডাউনের আওতায় আসে।
পরবর্তীকালে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে কেবলমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব কিছুই পর্যাক্রমে খুলে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে দেশের সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে আরম্ভ করে। এমনিতেই বাঙালি সাহসি জাতি তার উপরে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সাহসিকতাপূর্ণ বাক্যের কারণে দেশের জনসাধারণ আরো সাহসি হয়ে ওঠে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘‘ করোনা আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলো অক্সফোর্ড। কিন্তু তাদের সেই আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এদিন তিনি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন আয়োজিত ‘‘ শতাব্দীর মহামারি করোনা, বাস্তবতা ও আমরা’’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারি ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম হয়েছে। চিকিৎসকগণসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে রোগীদের চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সময় মত করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গ যোগাযোগ করা হচ্ছে এবং ভ্যাকসিন উৎপাদনে এগিয়ে আছে এমন অনেক দেশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। করোনা সংক্রমণ রোধে জনগণকে মাস্ক পরিধান, পরিবহনে যাতায়াতে সতর্কতা, সাবান বা সেনিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করা ইত্যাদি স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা, করোনাভাইরাস সনাক্তে টেষ্টের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে বলেও জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রী।’’
করোনাভাইরাস বিদায় নিতে বসেছে এই আশায় দেশের করোনা হাসপাতাল গুলোর শয্যা সংখ্যা ইতোমধেই ৮১ শতাংশ হয়েছে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিন এ গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ একটি খবর ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, রোগীশূন্য হয়ে পড়ছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলো। সারা দেশে করোনা হাসপাতালের সাধারণ শাখার ৮১ শতাংশ এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের শয্যা ( আইসিইউ) ৪৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ ফাঁকা হয়ে গেছে। রোগী না থাকায় ছয়টি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি বন্ধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। দেশে প্রতিদিনই কমছে করোনা রোগীর সংখ্যা।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর দৈনিক সনাক্ত রোগীর যে পরিসংখ্যান প্রতিদিন দিচ্ছে, তাতে সংক্রমণ কমে আসার একটি ধারণা মনে জাগলেও দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা কমে ্আসায় ওই পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্র দিচ্ছে কিনা সে সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মধ্যে। যারা নিজ থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন, কেবল তাদের তথ্যই সরকারি খাতায় আসছে। যাদের উপসর্গ সেভাবে নেই, তারা হিসাবের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। জনসংখ্যার অনুপাতে দেশের কোন এলাকায় কতটা ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস, সেই বিশ্লেষণও জানা যাচ্ছেনা ওই পরিসংখ্যান থেকে। কাজেই পরীক্ষা বাড়িয়ে সঠিক চিত্র তুলে আনার ব্যবস্থা না হলে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদি সংক্রমণ চক্রে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালকও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা ডা. বেনজির আহমেদ।
তিনি বলেন, প্রতিদিন যে প্রতিবেদনটা দিচ্ছে, সেখানে সংক্রমণের মাত্রাটা কমছে। কিন্তু মহামারির প্রকৃত চিত্রটা আমরা পাচ্ছিনা। কোথায় সংক্রমণ বাড়ছে কোথায় কমছে তা আমরা জানিনা। আমরা অ্যান্টিবডি টেষ্ট করছিনা। অ্যান্টিবডি টেষ্ট দিলে বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণের অবস্থাটা দেখতে পাবো। ’’(দৈনিক সিনসা-২৫ সেপ্টেম্বর-২০২০)।
তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের চাইতে সুস্থ্যতার হার অনেক বেশি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যেমন আজ ৬ অক্টোব ২০২০ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা সাক্ষরিত করোনাভাইরাস বিষয়ক এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে এপর্যন্ত ৫ হাজার ৪০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সনাক্তের তুলনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত ২৪ ঘন্টায় সনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৯৯ সহ এপর্যন্ত মোট সনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৩১ জন। সনাক্তের হার ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। এসময়ের মধ্যে সুস্থ্য হয়েছেন ১ হাজার ৬৫১ জন সহ মোট সুস্থ্য রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩৩ জন। সুস্থ্যের হার ৭৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
আশার কথা এইযে, ইতোমধ্যেই বিশে^র বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে এবং তা পরীখক্ষা করে বিশেষ ফল পাওয়া গেছে। মার্কিন ওষুধ প্রস্তুত কারক সংস্থা জনশন এন্ড জনশন যে টিকা আবিষ্কার করেছে তাতে তাদের তৈরি প্রতিষেধকের একটি ডোজই কার্যকরি বলে জানা গেছে। ওই একটি ডোজই নোভেল করোনার বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রধম ও মধ্যবর্তী ধাপে ইতোমধেই তা প্রমাণিত। বিশে^ নোভেল করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা যখন তিন কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে, সেই সময় একটি অন্তর্বতীকালীন রিপোর্টে এমনটাই দাবি করলো মার্কিন ওষুধ প্রস্তুত কারক সংস্থা জনশন এন্ড জনশন।
আরো আশার কথা এইযে, করোনা টিকা বন্টনে ১৫৬ টি দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে বলে জানা গছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ২৩ সেপ্টেম্বর ,২০২০ সংখ্যার খবরে জানা যায় যে, করোনাভাইরাসের নতুন কোন টিকা পাওয়া গেলে তা বিশ^ব্যাপী দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গত বিতরণ করতে একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে সম্মত হয়েছে বিশে^র ১৫৬ টি দেশ। চুক্তিতে সম্মত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশকে দ্রুত এ টিকা দেওয়া হবে। এর আওতায় পড়বে ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা খাত, বিশেষ করে সম্মুখ সারিতে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীও সামাজিক সেবা খাতে যুক্ত লোকজন।
ধনী দেশগুলোর সঙ্গে যেন দরিদ্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোও ভ্যাকসিন পায় সেটি নিশ্চিতে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে কোভ্যাক্স কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।
মোবাইল ফোন নং ০১৭১২২৩২৪৬১