নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় বাড়িতে ঢুকে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় এক ইউপি সদস্যসহ আরো দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তাররা হলেন পূর্ব একলাশপুর গ্রামের নোয়াব আলী বেপারী বাড়ির লোকমান হোসেনের ছেলে সাজু (২১) এবং জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত গোলাম মোস্তফার ছেলে মোজাম্মেল হোসেন সোহাগ (৪৮), যিনি একলাশপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য।
বেগমগঞ্জ থানার ওসি হারুনুর রশিদ চৌধুরী জানান, সোমবার রাতে সাজুকে ঢাকার শাহবাগ থেকে এবং সোহাগকে তার বাড়ির এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে বেগমগঞ্জ থানা পুলিশ।
সাজু নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার ৫ নম্বর আসামি। আর আদালতে ভুক্তভোগীর দেওয়া জবানবন্দিতে সোহাগের নাম আসায় তাকেও এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে জানান ওসি।
এ মামলায় এ নিয়ে মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হল। এর আগে রোববার রাতে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রহিম ও রহমত উল্যাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই দিনে র্যাব ঢাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি বাদল এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করে।
বাদলকে ইতোমধ্যে বেগমগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র্যাব। তাকেসহ সাজু ও সোহাগকে মঙ্গলবার নোয়াখালীর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করার কথা রয়েছে।
নির্যাতনের শিকার ওই নারী বাদী হয়ে রোববার রাতে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় পর্নোগ্রাফি আইনে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ৯ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করেন।
রহিম ও রহমতকে সোমবার জেলার ৩ নম্বর আমলী আদলতে হাজির করে দুই মামলার ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে বিচারক দুই মামলার তাদের ৬ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
বেগমগঞ্জ উপজেলায় ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানোর এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপর ৩৫ বছর বয়সী ওই নারীকে উদ্ধার করে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয় পুলিশ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, দাম্পত্য কলহের জেরে ওই নারী একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তার বাবার বাড়িতে থাকছিলেন। দীর্ঘদিন পর গত ২ সেপ্টেম্বর তার সঙ্গে দেখা করতে সেখানে যান তার স্বামী।
সেদিন রাত ৯টার দিকে আসামিরা তাদের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে এবং ওই নারীর স্বামীকে মারধর করে পাশের আরেকটি ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখে। পরে তারা ওই নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা করে।
তাতে বাধা দিলে আসামিরা তাকে নির্যাতন করে এবং মোবাইল ফোনে সেই দৃশ্য ভিডিও করতে থাকে। ওই নারীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে আসামিরা কাউকে কিছু জানালে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
সেখানে বলা হয়েছে, ওই নারী কাউকে কিছু না জানিয়ে জেলা শহরের মাইজদীতে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেও আসামিরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ‘কুপ্রস্তাব’ দেয়। রাজি না হলে সেই রাতের ভিডিও তারা ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
ওই নারী তাদের কথায় রাজি না হওয়ায় আসামিরা রোববার দুপুরে সেই ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। পরে পুলিশ খবর পেয়ে বোনের বাসা থেকে ওই নারীকে সরিয়ে নিয়ে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয় বলে বেগমগঞ্জ মডেল থানার ওসি হারুনুর রশীদ জানান।
ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক একজন নারীকে বিবস্ত্র করে মারধর করছে। তাদের একজন পা দিয়ে ওই নারীর মুখ চেপে ধরেছে। বারবার আকুতি জানানোর পরও নির্যাতন করা বন্ধ করেনি তারা।
হাই কোর্ট ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নির্যাতনের ওই ভিডিও অপসারণ করতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে। তবে মামলার আলামত হিসেবে ভিডিওটি পেনড্রাইভ বা সিডিতে সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে।
সেই সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত নারী ও তার পরিবারকে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ওই নারীর নিরাপত্তা, জবানবন্দি নেওয়া, দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার্বিক ঘটনায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো অবহেলা আছে কি না তা অনুসন্ধানে নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছে হাই কোর্ট।
কমিটিকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে হাই কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জেলার সমাজ সেবা কর্মকর্তা ও চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের অধ্যক্ষকে কমিটিতে রাখা হয়েছে।
এদিকে ওই ঘটনার প্রতিবাদে নোয়াখালীসহ সারা দেশেই বিক্ষোভ-মানববন্ধনের মত কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন। নিপীড়কদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হচ্ছে সেসব কর্মসূচি থেকে।