মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হবার ২ বছর পর থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশ পরিচালিত হয়ে আসছে। তাই নির্বাচন বা ভোট বাঙালিদের জন্য গণতন্ত্রের নিয়ম রক্ষা এবং একটি আনন্দের বিষয়। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অুনষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৯৩ টি, জাতীয় সমাজ তান্ত্রিক দল ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ১ টি এবং সর্বদল ৫টি আসন লাভ করে। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা। তবে মাঝখানে বেশ কিছুকাল শৈ^র শাসকেরা ও দেশ পরিচালনা করেছেন। তখন গণতন্ত্র ছিলো অবরুদ্ধ। স্মর্তব্য যে, ১৯৭৫ সালের ১৫আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সুচনা হয়। নানা নাটকীয়তার পর সেনা শাসক জেনারেল জিয়া ও জেনারেল হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০০৯সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বাংলার মানুষ গনতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পায়। তখন থেকে অদ্যাবধি সেই ধারায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে জাতীয় সংসদের কোন আসন শুন্য হলে ৯০ দিনের মধ্যে সেই আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। কিন্তু ২০২০ সালে বেশ কটি আসন শুন্য হলে বৈশ্যিক মহামারি করোনাভাইরাসের আক্রমণে বাংলাদেশের অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়ে। ফলে জাতীয় সংসদের শুন্য আসন গুলোতে উপনির্বাচনের আয়োজনের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। এদিকে গত ১৮ জানুয়ারি সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের মৃত্যুতে বগুড়া-১ এবং ২১ জানুয়ারি ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুতে যশোর -৬ আসন শুন্য হয়। মহামারি করোনার কবলে পড়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার শেষ সীমায় উপনীত হয়ে বলতে গেলে নিরূপায় অবস্থার মধ্যেই ইসিকে দুটি উপনির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করতে হয়। মহামারি করোনাকালে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থার ফলে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা, ভোট গ্রহণে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সাধারণ ভোটারদের মাঝে করোনা ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হবে বিধায় দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ শুধীমহল থেকে নানান কথা ওঠে।
কিন্তু এই দুটি আসনে ১৪ জুলাই ধার্যৃকত তারিখে ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করণের জন্য গত ৪ জুলাই তারিখে করোনাভাইরাসের ১১৯ তম দিনে যেখানে এদিন মৃত্যু ২৯ জনসহ মোট মৃত্যু সংখ্যা ১ হাজার ৯৯৭ জন এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৯ জন । এরই মাঝে বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনে উপ-নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অটল থেকে নির্বাচন কমিশন এদিন একটি সভা করে। ইসি সুত্রে প্রকাশ,উক্ত সভায় কমিশনার মাহবুব তালুকদার ছাড়া অন্য কমিশনাররা অংশ নেন। নির্বাচন কমিশনার মোঃ রফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন করা ছাড়া কোন উপায় নেই মর্মে আমরা সবাই একমত হয়েছি।’’ ভোট কেন্দ্রে হ্যান্ড সেনিটাইজার ও হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত বেসিন রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই দুটি আসন ছাড়াও বর্তমানে পাবনা-৪, ঢাকা-৫ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসন শুন্য রয়েছে। এর মধ্যে পাবনা-৪, ঢাকা-৫ আসনে দ্বিতীয় ৯০ দিনে ভোট গ্রহণের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।’’
করোনাকালের মধ্যে উপ-নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, ‘‘ সংবিধানে বধ্যবাধকতা থাকায় করোনা ও বন্যা মাথায় নিয়েই নির্বাচন করতে হচ্ছে। ভোটাররা যাতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে ভোট দিতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই করোনাকালে ভোট দিতে গিয়ে কোনো ভোটার যদি করোনায় অসুস্থ্য হয়ে মারা যান তার দায়ভার নির্বাচন কমিশন নেবেনা। তিনি গত ১০ জুলাই বগুড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচন উপলক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংএ এসব কথা বলেন। সিইসি করোনাকালে কয়েকটি দেশের নির্বাচন সম্পর্কে উদাহরণ দিয়ে বলেন, করোনার ভয়াবহতার মধ্যেও ইটালি, ফ্রান্স, উগান্ডা এবং আমেরিকার একটি রাজ্যে সম্প্রতি নির্বাচন হয়েছে। আরো কয়েকটি দেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে।’’ এর আগে দুপুর ১২ টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচন বিষয়ে যশোরেও মত বিনিময় করেন।
করোনাকালে দেশে যে কটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে পাবনা-৪ আসনে। এই আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন শামসুর রহমান শরীফ ডিলু। তিনি পরপর চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। প্রবীন রাজনীতিবিদ পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ভাষা সেনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান শরীফ ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী। তিনি গত ২ এপ্রিল-২০২০ তারিখে মৃত্যবরণ করায় এই আসনটি শুন্য হয়। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর শনিবার ভোটের দিন ধার্য করা হয়।
পাবনা-৪ ঈশ^রদী-আটঘরিয়া এই আসনটির উপনির্বাচনের তপসিল ঘোষণার পর হতেই আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হবার জন্য বিপুল সংখ্যক প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন লাভের জন্য বিভিন্ন দেনদরবার চালাতে থাকেন। জানা যায়, পাবনা-৪ আসনে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রয়াত ভূমিমন্ত্রীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ, ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ, মেয়ে মাহজেবিন শিরিন পিয়া, জামাতা আবুল কালাম আজাদ মিন্টু, মন্ত্রীর খালোতো ভাই, ভাগ্নি জামাই সকলেই মনোনয়ন পেতে নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ডিজি এফ আই এর সাবেক ডিজি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আলহাজ নজরুল ইসলাম রবি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেউল রহিম লাল, ঈশ^রদী উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ^াস, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাড. রবিউল আলম বুদু, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিষ্টার সৈয়দ আলী জিরু, শিল্পপতি জালাল উদ্দিন তুহিন, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশীদুল্লাহ, আওয়ামী লীগ নেতা পাঞ্জাব আলী বিশ^াস, আটঘরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র শহিদুল ইসলাম রতন এবং মিজানুর রহমান স্বপনসহ মোট ২৮ জন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনায়ন বোর্ড দলীয় প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচনায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ^াসকে দলীয় মনোনয়ন দেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও পাবনা জেলা কমিটির আহবায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব (১৯৯১ সালে তদানিন্তন ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিবকে এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী সিরাজ সরদার বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ হাবিবকে মনোনয়ন না দিয়ে ভাষা সৈনিকও বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান শরীফকে মনোনয়ন দিলে হাবিবুর রহমান হাবিব দল ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেন।) এবং জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে মোঃ রেজাউল করিম দলীয় মনোনয়ন লাভ করে ভোটের মাঠে নেমেছেন। ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ^রদী- আটঘরিয়ার ২ টি পৌরসভা, ১২ টি ইউনিয়নের ১২৯ টি ভোটকেন্দ্রে ৩লাখ ৮১ হাজার ১১২ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। করোনাকালে ভোটের মাঠে ত্রিমুখি লড়াইয়ে কে হারবেন কে জিতবেন তার ফয়সালা হবে ২৬ সেপ্টেম্বর। এখন শুধুই প্রতীক্ষার পালা। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।