ক্যান্সার সারভিক্স বা জরায়ু- গ্রীবার ক্যান্সার

ক্যান্সার সারভিক্স বা জরায়ু-গ্রীবাদেশের ক্যান্সার আক্রান্ত হন সাধারণত ৪০ থেকে ৪৫ বছরের মহিলারা। তবে এই প্রাণঘাতী রোগীর প্রাথমিক পর্যায়ের উপস্থিত সূচনা হয় এবং অন্তত ১০ বছর আগে অর্থাৎ ৩০ বা ৩৫ বছরের মধ্যে।
এ অবস্থাকে করা হয় কারসিনোমা ইন সিটু বা কোষের মধ্যে যে ক্যান্সার এখনো আবদ্ধ আছে।

এর কারণ কি কি?

ক্যান্সার সারভিক্স-এর কারণ সঠিকভাবে নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি আজও, তবে কিছু কিছু তথ্য এবং পরিবেশ পর্যায়ের কারণ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণা আনুযায়ী বের করা সম্ভব রয়েছে। যেসব কারণে ক্যান্সার সারভিক্স-এর মতো ঘাতক ব্যাধির আক্রমণ হয়ে থাকে, সেগুলো হলোঃ

(১) বহু কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে অত্যন্ত অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হওয়া।

(২) বহু সন্তানের জননীদের মধ্যে ক্যান্সার সারভিক্স-এর প্রবণতা অত্যন্ত বেশি।
এ থেকে অনুমান করা হয় অধিক সন্তান ও ঘন ঘন সন্তান প্রসব ক্যান্সার সারভিক্স-এর কারণ।

(৩) যেসব মহিলারা নোংরা এবং
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন-যাপন করেন তাদের মধ্যেও ক্যান্সার সারভিক্স-এর প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

(৪) গ্রামাঞ্চলের ও শহরের নিয়মবৃত্তি অনেক মহিলাই মাসিক ঋতুস্রাবের সময় পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন এবং সেইগুলো নিয়তি পরিষ্কার করে না। এটি জীবাণু সংক্রমণের একটি প্রধান উপায়।কারণ, জীবন ও ন্যাকড়ার গায়ে লেগে থাকা রক্তের সংস্পর্শে এলে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।

(৫) যেসব মহিলারা ক্যান্সার সারভিক্স প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়েনি বা চিকিৎসা হয়নি তাদের মধ্যে পরবর্তী পর্যায়ে এ ক্যান্সারের প্রবণতা শতকরা ৩০-৪০ভাগ বেড়ে যায় ।

(৬) ক্যান্সার সারভিক্স-এর হিসেবে বিজ্ঞানীরা এক প্রকার ভাইরাস শনাক্ত করেছেন, যার নাম হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস-২। এ ভাইরাস অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে বেঁচে থাকে ও বংশবিস্তার করে।

(৭) মহিলাদের ক্যান্সার সারভিক্স-এর কারণ হিসেবে স্বামীদের সারকামসিশন না কারনোকেও দায়ী করা হয় ।

(৮) প্রমিসকিউটি বা বহু যেওনসঙ্গীর সঙ্গে মিলনের মাধ্যমেও একজন মহিলা ক্যান্সার সারভিক্স-এ আক্রান্ত হতে পারে ।

ভাইরাস কিভাবে আক্রমণ সৃষ্টি করে?

দেখা গেছে ভাইরাস যৌনঙ্গে প্রবেশের পর এক ধরনের আব (genital warty) বংশবিস্তার করে ।
ভাইরাস কোন বাধা না পেলে ইচ্ছেমতো কাজ করে যায়। তারা একের পর এক কোষকে আক্রমণ করে যায় এবং কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে সংখ্যায় বাড়তে থাকে । এর ফলেই তৈরি হয় আব অবস্থার । অবস্থা আরো খারাপ হলো কোষের মতিগতি পাল্টে যায় এবং তারা দ্রুত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় ।


বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখেছেন,শতকরা ৯০ ,ভাগ জরায়ু- গ্রীবার ক্যান্সারের সঙ্গে প্যাপিলোমা ভাইরাস জড়িত রয়েছে । মানুষ শরীরে অন্তত ৭০ রকমের প্যাপিলোমা ভাইরাস বসত গাড়তে পারে । এরা ত্বক, মুখগহ্বর, মূত্রনালী,যৌনাঙ্গের ঝিল্লিসহ বিভিন্ন আবরণী কলায় আবাস গেড়ে থাকে । শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ মহিলার জরায়ু-গ্রীবার কোষ প্যাপিলোমা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে কোষের অস্বাভাবিক দেখা যায় । কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে ও ধরনের অস্বাভাবিক কোষে ক্যান্সার কোষের পরিণত হয় । একসময়ে তা পুরো জরায়ু-গ্রীবায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আনুষঙ্গিক জটিলতা নিয়ে আত্নাপ্রকাশ করে ।

প্রতিরোধের উপায় :

বাল্যবিবাহ বা অল্প বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার যে প্রথা এখনো আমাদের সমাজে রয়েছে তা বন্ধ করতে হবে । কারণ অল্প বয়সে যৌনসঙ্গম ক্যান্সার সারভিক্স আরো অনেক জটিলতা একটি আত্নাঘাতী ব্যবস্বা । একটি মেয়ের কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সের অর্থাৎ পরিপূর্ণ দৈহিক বিকাশ সুসম্পন্ন হওয়ার পরই কেবল বিয়ে হওয়া উচিৎ ।

ঘন ঘন সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের সমাজে ও ব্যাপারে সাধারণত মহিলাদের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। অথচ, একজন মাহিলাকেই সর্বতোভাবে এর সুফল ভোগ করতে হয় । তাই কখন সন্তান নেবেন এবং কতটি সন্তান নেবেন এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একজন মহিলারই অগ্রাধিকার থাকা উচিৎ ।

নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ গ্রাম্য ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব করানোর সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলাদের যৌনিপ্রদেশে প্রদাহ ও সংত্রুমণের সৃষ্টি হয় এবং একসময় ত্রুনিক সারভিক্স-এ আত্রুন্ত হয় । এর পরিণতি স্বরুপ ক্যান্সার সারভিক্স দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে । একজন গর্ভবতী মহিলাকে গর্ভাবস্থায় সুচিকিৎসা করানোর পাশাপাশি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে প্রসব করানো উচিত, যাতে গর্ভকালীন সকল জটিলতা যথোপযুক্তভাবে মোকাবেলা করা যায় ।

                
 
প্রফেসর ডা: সুলতানা জাহান

রোগ নির্ণয়:

ক্যান্সার সারভিক্স অত্যন্ত অবস্থায় নির্ণয় করা আজ আর মোটেও কঠিন বিষয় নয় । প্রয়োজনে শুধু একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ।

ঘন ঘন সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের সমাজে ও ব্যাপারে সাধারণত মহিলাদের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। অথচ, একজন মাহিলাকেই সর্বতোভাবে এর সুফল ভোগ করতে হয় । তাই কখন সন্তান নেবেন এবং কতটি সন্তান নেবেন এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একজন মহিলারই অগ্রাধিকার থাকা উচিৎ ।

নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ গ্রাম্য ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব করানোর সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলাদের যৌনিপ্রদেশে প্রদাহ ও সংত্রুমণের সৃষ্টি হয় এবং একসময় ত্রুনিক সারভিক্স-এ আত্রুন্ত হয় । এর পরিণতি স্বরুপ ক্যান্সার সারভিক্স দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে । একজন গর্ভবতী মহিলাকে গর্ভাবস্থায় সুচিকিৎসা করানোর পাশাপাশি অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে প্রসব করানো উচিত, যাতে গর্ভকালীন সকল জটিলতা যথোপযুক্তভাবে মোকাবেলা করা যায় ।

রোগ নির্ণয়:

ক্যান্সার সারভিক্স অত্যন্ত অবস্থায় নির্ণয় করা আজ আর মোটেও কঠিন বিষয় নয় । প্রয়োজনে শুধু একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের । তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে মহিলাদের আরো সচেতন হওয়া,কুসংস্কার ত্যাগ করা এবং রোগকে চাপিয়ে রাখার প্রবণতা ত্যাগ করা । কারণ, এর এমন কতগুলো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে যা থেকে সহজেই রোগের উপস্থিতি সম্পর্ক প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়। বিশেষ করে ৪৫ ঊর্ধ বয়সে কারো যদি কোন অস্বাভাবিক সাদা স্রাব, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব বা অনিয়মিত মাসিক ঋতুস্রাব হয় তাহলে জরুরীভিত্তিতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।


পেপস স্মিয়ার (Paps smear) টেস্ট একটি সহজ পরীক্ষা, যার সাহায্যে ক্যান্সার সারভিক্স প্রাথমিক অবস্থায়ই নির্ণয় করা সম্ভব । এই পরীক্ষাটি বিশেষ করে ৩৫ বছরের বেশি বয়সের মহিলাদের প্রতি ৬ মাসে অন্তত একবার করা উচিত । এক বলে স্রিনিং । শুধু এ ধরনের সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রসারে মাধ্যমেই ক্যান্সার সারভিক্স প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং ক্যান্সার হলেও অকুরে ডায়াগনোসিস ও সহজ অস্রোপচারের মাধ্যেম তা নির্মূল করা সম্ভব।

বিভিন্ন স্টেজ বা পর্যায় :
চিকিৎসা চিকিৎসাবিজ্ঞানে ক্যান্সার সারভিক্সকে কয়টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়ঃ

স্টেজ “০” বা একেবারে প্রাথমিক অবস্থা ঃ এ অবস্থাতে বিভিন্ন পরীক্ষারীক্ষায় রোগনির্ণয় করা সম্ভব । এ অবস্থায় ধরা পড়লে চিকিৎসায় ।

অতি সহজেই রোগিনী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতে পারে । পেপস স্মিয়ার ও বায়োপসি উভয় পরীক্ষায়ই এ স্টেজে রোগনির্ণয় করা সম্ভব ।

স্টেজ “১” ঃ এ অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে শৈল্য-চিকিৎসা বা অস্রোপচার কিংবা হিস্টোপ্যাথলজির রিপোর্ট অনুয়ায়ী রেডিওথেরাপি দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবে যথোপযুক্ত চিকিৎসা করালে রোগিনী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন ।

স্টেজ “২” ঃ এ অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে শৈল্য-চিকিৎসা ও রেডিওথেরাপি উভয় চিকিৎসা সংযুক্তভাবে করানোর প্রয়োজন হয়। উপযুক্ত চিকিৎসায় যোগিনীর সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা থাকে ।

স্টেজ “২বি” ঃ এ অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে শুধু রেডিওথেরাপি বা ক্যান্সারের সেক দেয়া হয় । রোগিনী অনেকাংশে আরোগ্য লাভ করে।

স্টেজ “৩-এ”, “৩-বিঃ এবং স্টেজ ” ৪-এ”, “৪-বি” ঃ এসব স্টেজে রোগ ধরা পড়লে বলতে হবে রোগ অনেক দূর এগিয়ে গেছে বা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। এরুপ অবস্থায় রোগ জরায়ু-গ্রীবাত থাকে নায়-তা মূত্রথলি, মলদ্বার এ শারীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়বে। তবু এ অবস্থায় রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা করলে রোগিনী অনেকাংশে উপসর্গমুক্ত থাকতে পারে।

সবশেষে আমি বলতে চাই,আমাদের মায়েদের ও মেয়েদেরকে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার জন্য স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের নিজেদেরকেই আরো বেশি সচেতন হতে হবে। সব রকম দ্বিধা জড়তা দূর করে নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তটি সঠিক সময়ে নিতে হবে ।

লেখক: প্রফেসর ডা: সুলতানা জাহান

সাবেক চেয়ারম্যান ও বিভাগীয় প্রধান
( গাইনী ও অবস )
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। মোবাইল: ০১৭১১-৫২৯২২৬