করোনা কালের জীবন ধারা (পূর্ব প্রকাশের পর ) (৫৩)

করোনার করালগ্রাসে সমগ্র বিশ^ যেন আজ অমাবশ্যার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। বৈশি^ক মহামারি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাাস গোটা বিশ^বাসীকেই গ্রাস করে ফেলেছে। আনবিক- পারমাণবিক অস্ত্রসহ মারনাস্ত্র আবিষ্কারে মুনসিয়ানাতে পারদর্শী দেশসমূহও আজ করোনার কাছে নতজানু। অতিক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাধারি অদৃশ্য- অস্পৃশ্য করোনাভাইরাস সকলকেই নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। এর নেই কোন প্রতিরোধ, নেই কোন প্রতিকার। কেউই এর লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হচ্ছেনা।
করোনাভাইরাস বিশে^র ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম মহামারি। এর চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাকে (হু) এর আগে কখনো পাড়তে হয়নি। গত ২৭ জুলাই-২০২০, এ কথা বলেছেন ‘হু’ এর মহাপরিচালক তেদরোস আদানম গেব্রিয়াসিস। ওই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে হু এর প্রধান বলেন, ‘‘এই নিয়ে ষষ্ঠবার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারি করলো স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে নিশ্চিভাবেই বলা যায়, এই ছয় বারের মধ্যে এবারই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। তেদরোস বলেন, সংক্রমণ ছড়ানোর ৬ মাস পরেও এ ভাইরাস গতি বাড়াচ্ছে। শুধু গত ৬ সপ্তাহেই বিশ^ জুড়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে গেছে। তিনি জানান, বিশ^ ব্যাপি মহামারি পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য চলতি সপ্তাহে ‘হু’ এর জরুরি কমিটির বৈঠকের আহŸান করবেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারির আগ পর্যন্ত ‘হু’ যে ৫ বার জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলো তার মধ্যে দুটি ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে ও একটি করে জিকা, পোলিও ও সোয়াইন ফ্লু নিয়ে। কিন্তু কোন ক্ষেত্রেই এবারের মতো পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়নি। তিনি বলেন, এই মহামারি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা।’’ গত ৩০ জানুয়ারি বিশ^ জুড়ে ‘পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি’ ঘোষণা করে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’।
এর আওতায় বাংলাদেশও ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে দেখতে দেখতে মার্চ মাসের ৮ তারিখে করোনাভাইরাস বাংলাদেশে তার নখের ছোবল বসালো। এতে ৩ জন আক্রান্ত হলেন এবং ১৮ মার্চ একজন মৃত্যুবরণ করলেন। শুরু হলো করোনার হলিখেলা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে আখ্যায়িত করেছেন করোনা যুদ্ধ বলে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহŸানে যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধে সেসময় ৩০ লাখ মানুষ তাদের মূলবান জীবন উৎসর্গ করে সাহাদত বরণ করেন্। ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহাণি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে মহামারি কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। দেশের অভ্যন্তরের সংখ্যা অজানা। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেমম্বর তারিখে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগি, এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশকে মেধাশুন্য করার মানসে বুদ্ধিজীবীদেরকে ধরে নিয়ে পাইকারি হারে হত্যা করা হয়।
২০২০ সালের করোনা যুদ্ধেও করোনাভাইরাসের হাত থেকে মন্ত্রী, এমপি,সচিব, বিচারক, ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারি বৃন্দ। সেনাসদস্য, র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসার, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা, চাকুরিজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী,ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রেহাই পাচ্ছেনা। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে অগণিত মানুষ।
বাংলাদেশ বিশে^র ঘন বসতি দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশের জনসংখ্যানুপাতে ভুখন্ডের পরিমাণ সীমিত আকারের। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা করোনাভাইরাসের বিচরণ ক্ষেত্রের জন্য বেশ উপজীব্য।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করার জন্য প্রথম থেকেই বিভিন্ন বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশের সকল অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারি, কলকারখানা, শপিংমলসহ দোকানপাট বন্ধ ঘোষণা করেন। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সারা দেশের সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপনের জন্য বছরের শুরু থেকেই জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের যে আয়োজন করেছিলেন, করোনাভাইরাসের কারণে তা বাতিল করেন।
দীর্ঘদিন ধরে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ পুরো লকডাউনের আওতায় ঘরবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করে করোনার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসিকে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাথ্য বিধি সম্পুর্ণভাবে মেনে চলার জন্য অনুরোধ জানান। তিনি বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে অর্থসহায়তা করেন। এরই সাথে পবিত্র রমজানের মাসের রোজা এবং রোজা শেষে ঈদুল ফিতরের আগমণ ঘটে। ঠিক সেই মূহুতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নেমে আসে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আমফান এবং সেই সাথে প্রবল আকারে জলোচ্ছ¡াস। সরকারের সময় উপযোগি পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে প্রাণহানি তেমন না ঘটলেও মানুষের জমির ফসল, মাছের ঘেরসহ মূল্যবান তৈজষপত্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
সেসময় আশা করা হয়েছিলো যে, মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা উদযাপনের সময় করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে সমূলে উৎপাটিত হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে করোনা যেন আরো জেঁকে বসছে। এই ঈদে পশু কোরবানী করা হয় বলে এই ঈদকে কোরবানীর ঈদ বলা হয়ে থাকে। সামর্থবানদের জন্য ঈদুল আযহায় কোরবানী করা ওয়াজেব। ঈদুল ফিতরের সময় ফিতরা আদায় করা যত সহজ ছিলো ঈদুল আযহায় পশু কোরবানী দেওয়া ততটা সহজ নয়। যদিও ধর্মীয় বিধান মতে একটি গরু অথবা মহিষ ৭ ভাগে কোরবানী করা যায় তাতেও মোটা অঙ্কের টাকার প্রয়োজন। করোনাভাইরাসের কবলে পড়ে মধ্যবৃত্ত ও নিন্ম মধ্যবৃত্ত লোকদের অবস্থা একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছে। ঈদুল ফিতরের সময় লকডাউনকালে মানুষ যেভাবে ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা হতে বাড়ির পথে রওনার জন্য কসরত করেছিলো, এবার তা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। বাস ষ্ট্যান্ডগুলো যাত্রীশুন্য। ট্রেন, লঞ্চ ও অন্যান্য যানবাহনে এবার ভিড় কম। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে একজন যাত্রীকে ভ্রমনের সময় দুইজনের ভাড়া দিতে হবে। এতে অনেকেই রাজি নয়। তবুও নাড়ির টানে বাড়ির পথে রওনা হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। এছাড়া ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’র মত ঈদুল আযহার পূর্ব মূহর্তে দেশের প্রায় ২১ টি জেলা বন্যা কবলিত। পানি বিশেষজ্ঞদের মতে এবারের বন্যা ৮৮ সালের বন্যার চেয়েও ভয়াবহ হবে। ঢাকাবাসিও বন্যার কবলে পড়বে বলে তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অপরদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় নদী ভাঙ্গনের ফলে মানুষজন নিজেদের জমিজমা- বসতবাড়ি হারিয়ে পাগলপ্রায়।
এবার ঈদুল আযহার জামায়াতও মসজিদেই আদায় করতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে খোদ সৌদি আরবে সীমিত আকারে হজ অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গত বছর যখন ২৫ লাখের মত মুসুল্লি হজব্রত পালনের সময় লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, তাকবির ও তালবিয়া ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করেছিলেন এবার মাত্র ১০ হাজার মুসলমানকে হজের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
করোনাকালের জীবনধারায় এবারে ঈদুল আযহার উৎসব পুরোপুরি পালন করা সম্ভব হবেনা। করোনার প্রাদুর্ভাবে সীমিত আকারে চলাফেরা করতে হবে। এমনিতেই এবার সরকারি ছুটি কম। তাই যারা ঈদ করতে বাড়ি আসবেন তাদেরকে জলদি কমস্থলে আবার ফিরতে হবে। এই আসা-যাওয়ার মাঝে করোনার আক্রমণের ঝুকি রয়েছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এদিকে ঈদুল আযহা উদযাপনকে ঘিরে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। তন্মধ্যে জনসমাগম এড়িয়ে চলা। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা। মুখে মাস্ক ব্যবহার করা। সেই সাথে সাবান দিয়ে বার বার কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সময় দুহাত ধৌত করা। হ্যান্ড সেনিটাইজার ব্যবহার করা ইত্যাদি। কোরবানী দেওয়ার সময় এবং পরে মাংস বিতরণের ক্ষেত্রে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
এবার করোনা কালের জীবন ধারায় ঈদুল আযহার আমেজ প্রতিটি মুসলমানের ঘরে ছড়িয়ে পড়–ক এবং বৈশি^ক মহামারি করোনার ছোবল থেকে বিশ^বাসি মুক্তি পাক। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে হোক সবার এই প্রার্থণা। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)। সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।