ধর্মীয় উৎসবে আমরা যেন ‘সামাজিক – দুরত্বনীতি’ অমান্য না করি

করোনা’র ভয়াবহতা কি ভয়ংকর তা বিশ্ববাসীর এখন বুঝতে আর বাকী নেই। ডিসেম্বর-১৯ এর শেষ থেকে এখনো এর ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। ধনি-দরিদ্র, রাজা-রানী, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, ডাক্তার, নার্স, সেনা সদস্য, পুলিশ, র‌্যাব, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, সাংবাদিক কাউকেই এই ভাইরাস ছাড় দিচ্ছেনা।

বিশ্বের খবরদারি করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রীতিমত নাজেহাল হয়ে গেছে করোনা মোকাবেলায়। বিৃটেন, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য কোনও দেশই আর বাদ নেই আক্রান্ত হতে। এখন প্রমান হয়ে গেছে; যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে নয়, বিশ্ব মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অর্থব্যয় করা উচিত ছিল। তাহলে হয়ত এ ধরনের ভাইরাসের প্রতিষেধক আগেই তৈরি হয়ে যেত।

সার্বিক এই করোনা পরিস্থিতি সারাবিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক সামাজিক কার্যক্রম ওলোট-পালোট করে দিয়েছে। আক্রান্ত হলেই আর কেউ কাউকে চিনছেনা-! আপনজন আর আপন থাকছেনা। যারা মারা যাচ্ছে তাদের মুখটাও শেষবারের মত দেখতে পারছেনা আপনজন। কি ভয়াবহ ব্যাপার-! কোথায় থাকলো আর সামাজিক সম্পর্ক-?

যাহোক ইতিমধ্যে আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষ চলে গেল। বাঙালির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িকতার এই উৎসবটি এবার কোন আনন্দ বয়ে আনতে পারেনি। এই দিনটিও আমরা পার করেছি করোনা-উৎকন্ঠায়। এর আগে স্বাধীনতা দিবসটিও পার হয়েছে একইভাবে, সাধারনভাবে কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। সকল অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর। আমরা সবই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি; কারন আমাদের তাড়া করছে ভয়ানক দুর্বৃত্ত করোনা।

এরমধ্যে সারাবিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলমানদের অন্যতম একটি মাস পবিত্র মাহে রমজান শুরু হয়েছে শনিবার (২৫ শে এপ্রিল) থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একদিন আগে শুক্রবার থেকে। একেবারে ভিন্ন এক রমজান মাস এটি। এর আগে এ ধরনের রমজান মাস দেখেনি মুসলমানরা। বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইতিমধ্যে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন ঘোষনা করেছে। যাতে মানুষের জমায়েত না হয়, সামাজিক দুরত্বটা যেন বজায় থাকে। ধর্ম পালন করতে যেয়ে যেন মানুষের মরণের কারণ আমরা সৃষ্টি না করি সেটাই এখন বড় একটি ব্যাপার।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মুসলমানের পবিত্রতম রমজান মাস শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এবার যে ধরণের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রোজা পালন করতে হবে, তার নজীর ইতিহাসে বিরল।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মুসলিমরা এবার প্রথামত আত্মীয়-পরিজন-প্রতিবেশিদের নিয়ে সন্ধ্যায় ইফতারি করতে পারবেন না এবং রাতে দল বেঁধে মসজিদে গিয়ে তারাবির নামাজ পড়তে পারবেন না। আমাদের দেশে রাজনীতির সঙ্গে ইফতার পার্টি’র একটি সংস্কৃতি যুক্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে রমজানের পরে যদি কোন নির্বাচন থাকে তাহলে পুরো রমজান মাসজুড়েই চলে ইফতার পার্টি। কিন্তু এবার আর ইফতার পার্টির সুযোগ নেই।

বিভিন্ন দেশের ইসলামি চিন্তাবিদরা ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘এবারের রমজান হবে মুসলমানদের জন্য একদম ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা এবং পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির সাথে তাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে।’
সন্দেহ নেই এবারের রমাজন মাস হয়তো মুসলিম ইতিহাসে একেবারে ভিন্ন, ব্যাতিক্রমী ঘটনা হিসাবে জায়গা পাবে।

সৌদি বাদশাহ মক্কা ও মদিনায় মুসলমানদের দুই পবিত্রতম মসজিদে তারাবি নামাজের অনুমতি দিয়েছে, তবে সাধারন নামাজিরা যেতে পারবেন না।
এছাড়া, সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে জারী করা কারফিউ সকাল ৯টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কিছুটা শিথিল থাকবে। তবে বিশ্বের বহু মুসলিশ দেশে সেই ছাড়টুকুও দেয়া হচ্ছেনা।
মিশরে রমজান মাসে জামাতে নামাজসহ যে কোন ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ। ইরানে আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই রমজান মাসে জনগণকে জামাতে নামাজ না পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জেরুজালেমে ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ আল আকসাতেও রমজানে নামাজ হবেনা শুধু দিনে পাঁচবার আজান হবে।

কেমন হবে এবারের ঈদ ?
এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষে মুসলমানরা কি এবার তাদের সেবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর প্রথাগতভাবে উদযাপন করতে পারবে? সম্ভাবনা নেই। ঈদের মাঠে সেই চিরাচরিত কোলাকুলি করে শুভেচ্ছা জানানো, এবার করোনার নিষেধাজ্ঞায় পরাজিত। ঐতিহ্যের সংস্কৃতিতে আঘাত করে ফেলেছে করোনা-ভাইরাস। এ এক আতংকের নাম। এখানে শক্তির লড়াই চলেনা, এখানে সচেতনতার লড়াই করে বাঁচতে হবে, বিকল্প কোন পথ খোলা নেই।
সুতরাং এখনও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের যে গতি-প্রকৃতি তাতে ঈদ উদযাপন কেমন হবে – তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে।
সৌদি গ্রান্ড মুফতি পাঁচদিন আগে ইঙ্গিত দিয়েছেন, এবারের ঈদের নামাজও ঘরে বসে পড়তে হতে পারে।

ইন্দোনেশিয়ায় ঈদের আগে শহর থেকে যে লাখ লাখ মানুষ তাদের গ্রামে যায়, তা এবার নিষিদ্ধ থাকবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীও তার দেশে একই সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তাছাড়া, পুরো রমজান মাস ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রাস্তায় যে মেলা হয়, তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ধর্ম পালনে, বিশেষ করে রোজা বা ঈদে, এ ধরনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ইসলামের ঐতিহ্যের একেবারে পরিপন্থী। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিমকে এবার আপস করতে হচ্ছে। কোন উপায় নেই।

আমরা যেন কোনভাবেই আবেগপ্রবন হয়ে সরকার ঘোষিত ‘সামাজিক দুরত্বনীতি’ অমান্য না করি। সেইদিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকতে হবে সব সময়। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকাটাই এখন আসল সংগ্রাম। বেঁচে থাকলে আবারো জাঁকজমকভাবে নিশ্চয় সবকিছু আমরা উদযাপন করতে পারবো। আমরা আাবরো ফিরে যেতে পারবো আমাদের চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা-উপধারায়। আমরা নিশ্চয় ফিরে পাবো আমাদের আপনজনদের স্পর্শ আর আলিঙ্গনের অনুভূতি।

( লেখক: ঈশ্বরদীর সিনিয়র সাংবাদিক. কলাম লেখক। সাবেক সভাপতি-ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব)।