দেশের বৃহৎ জলাভূমি চলনবিলে এখন থইথই পানি নেই, অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। ফলে বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে চলছে ধান কাটা কিংবা অন্য ফসল রোপণের কাজ। তবে বিলের নিচু জায়গা বা বড় খালগুলোতে শুরু হয়েছে মাছ ধরার উৎসব। ভেসাল, সুতিজাল, বেড়জাল, পলো দিয়ে মাছ ধরছেন জেলেরা। আর পাশেই বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয়েছে শুঁটকির অস্থায়ী চাতাল। সেখানে মিঠা পানির বিভিন্ন ধরনের মাছের শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে।
বৃহত্তর চলনবিলের শুঁটকি মাছ তৈরি করে ভাগ্য বদলে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের। দেশের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে ওই সব এলাকার নিু আয়ের মানুষ। সেই সঙ্গে জাতীয় আয়েও অবদান রাখছেন তারা।
জেলা মৎস অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নাটোর সদরসহ সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম উপজেলা জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ চলনবিল। মৎস্য স¤পদে ভরপুর চলনবিল এলাকারমৎস্যজীবীদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে শুঁটকি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। চলনবিলের মাছ স্বাদযুক্ত হওয়ায় এ মাছের শুঁটকির চাহিদাও বেশি। বছরের ছয় মাস টেংরা, পুটি, চান্দা, চিংড়ি, গুচিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন তারা।
সরেজমিনে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে সিংড়া উপজেলার নিক্সগুইন এলাকার শুঁটকি শুকানোর চাতালে গিয়ে দেখা যায়, দলবেধে নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। রোদের মাঝে শুঁটকি ওলট-পালট করে দিচ্ছে কেউ কেউ। তাদের মধ্যে কেউ আবার ছোট-বড়, ভালো-মন্দ শুটকি আলাদা করতে দম ফেলার সময় পাচ্ছেন না।
মহাসড়কের পাশেই বসে গেছে অস্থায়ী বাজার। গাড়ি থামিয়ে দামদর করে বিলের বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি কিনছেন অনেকেই। শুঁটকি ব্যবসায়ী জয়নাল মিয়া জানা, এসব শুঁটকি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি বিদেশেও যায়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলনবিলের শুঁটকি আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ ১০-১২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চলতি মৌসুমে এখানে ১৫০-২০০ মেট্রিক টন শুঁটকি তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। যার আর্থিক মূল্য হবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
বিলের মধ্যেই শুঁটকি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, চলতি বছর চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫০টি অস্থায়ী চাতাল বসেছে। এসব চাতালে শোল, বোয়াল, পুঁটি, খলশে, চেলা, টেংরা, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, বাইমসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মানভেদে এই শুঁটকি মাছকে এবিসি গ্রেডে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে এ গ্রেডের বা ভালো মানের শুঁটকি রপ্তানি হয় আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব,
কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ ১০-১২টি দেশে। মূলত ঢাকার ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরেই এখানকার শুঁটকি বিদেশে যায়। আর বি ও সি গ্রেডের শুঁটকি মাছ বিক্রি হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, নীলফামারী, রংপুর, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। শুঁটকির আকারভেদে দাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছোট আকারের মাছের শুঁটকি প্রতিমণ ১৬ থেকে ২৪ হাজার টাকা
পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বড় আকৃতির মাছের শুঁটকি ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকা মণ। সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়।
নাটোরের গুরুদাসপুরের বিলশা, সাবগাড়ী, পিপলা, খুবজীপুরে, সিংড়া কৃষ্ণপুর, নুরপুর, বামিহাল, পাবনার চাটমোহর, তাড়াশের মহিষলুটি মাছের আড়তে শুঁটকি শুকাতে ব্যস্ত অনেক নারী-পুরু
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, চলনবিলের পাঁচটি জেলার ১২টিউপজেলায় হাজারো শ্রমিক তাদের ব্যস্ত সময় পার করছেন। নারী-পুরুষের হাতের তৈরি চলনবিলের শুঁটকি এখন দেশ ছেড়ে বিদেশেও যাচ্ছে। শুঁটকি তৈরিতে নারীদের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই শুটকি প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করতে পারলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
বৃহত্তর চলনবিল সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে দেশীয় পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। ভোরের আলো শুরু হতে না হতেই শুরু হয় তাদের কর্মযজ্ঞ। মাছে লবণ মাখানো, ওজন করা, মাচায় নেয়া, বাছাই করা শুকানো আরো কত কাজ। আর এসব কাজের বেশির ভাগই হয় নারীদের হাতে।
চলনবিলের মিঠা পানির মাছের শুঁটকির জন্য বেশ সুনাম রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে রাস্তার পাশেই তৈরি হয় বিশাল এলাকাজুড়ে বসে শুঁটকি মাছ তৈরির কারখানা। চলনবিলের অধিকাংশ মাছ চলে আসে জেলা-উপজেলা সদরের আড়ত ও বাজারে। সেখান থেকে পাইকাররা শুঁটকির জন্য কিনে নিয়ে আসেন প্রচুর মাছ। তবে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে মাছের বিশাল মৌসুম। ওই সময়ই বেশি চলে শুঁটকির মাছ সংগ্রহ। এসময় বর্ষার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় শুরু হয় এই কর্মযজ্ঞ।
শুঁটকি ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন জানান, চলনবিলের শুঁটকি মাছের স্বাদ ও মান ভালো হওয়ায় দেশ-বিদেশে এর চাহিদা বেশি। আশ্বিন মাস থেকে শুটকির চাতালে মাছ শুকানো শুরু হয়েছে। অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত চলে শুকানোর কাজ। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শুঁটকি ব্যবসায়ীরা মাছ শুকানোর চাতাল তৈরি করেছেন। ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করা যায়।
গুরুদাসপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম জানান, পানি কমতে থাকলে বিলের বিভিন্ন স্থানে সোঁতিজাল পাতা হয়। জালে ধরা পড়ে পুঁটি, খলসে, চেলা, টেংরা, বাতাশি, চিংড়ি, নলা, টাঁকি, গুচি, বাইম, বোয়ালসহ নানা জাতের মাছ। এসব মাছ চাতালে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। ২৫০ টাকা থেকে ৮ শ টাকা দরে প্রতি কেজি শুঁটকি মাছ বিক্রি করা হয়।
শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিক রিতা রাণী, রজুফা বেওয়া ও রিনা খাতুন জানান, তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি মাছ তৈরি হয়। এই ব্যবসা আর্থিকভাবে সচ্ছলতার পাশাপাশি ঝুঁকিও অনেক বেশি। ঠিকমতো পরিচর্যা করতে না পারলে শুঁটকি মাছে পোকা লেগে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আবহাওয়া খারাপ হলে, রোদ না থাকলে বিপদে পড়তে হয়।
শুঁটকি পল্লীর কয়েকজন মালিক জানান, সরকারি জায়গা লিজ নিয়ে চালানো এ পল্লীতে কাজ করছেন হাজারো শ্রমিক। শুধু রোদে দেয়া নয়, সারাদিন তাদের কাজ কয়েকবার শুটকি উল্টে-পাল্টে দেয়া। রোদ কম থাকলে শুকাতে লাগে তিন-চার দিন। আবার রোদ বেশি থাকলে একদিনেই শুঁটকি হয়ে যায়। তবে বড় মাছে সময় বেশি লাগে। এই ছয়মাস তাদের মাছ কেনাও লাগে না। মালিকরা নিয়মিত খেতে দেন। তাতে কম মজুরিতে কাজ করেও খুশি হন তারা।গ্রামের সহজ সরল এসব শ্রমিক অল্পতেই তুষ্ট। তাই সারাদিন বিরামহীন খেটেও মুখে কষ্টের ছাপ নেই। এই শ্রমিকদের এই দৃঢ় কর্মদক্ষতায় ভালো মহাজনরা সবসময় ভালোই থাকেন।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, সব কিছু মিলিয়ে চলনবিল অঞ্চলের শস্য ও মৎস্য ভান্ডার নামে খ্যাত এই অঞ্চলের ফসলাদি ও মৎস্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে দেশ আর্থিকভাবে অনেক উন্নতি লাভ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।