বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: সিলেটের বিশ্বনাথের কুখ্যাত ইয়াবা সম্রাট তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে গ্রেপ্তারের দাবিতে রীতিমত উত্তাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। গত ৬ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে তার স্ত্রী ইয়াবা সম্রাজ্ঞী সাবিনা আক্তার ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি বিরাজ করলেও ইয়াবা সম্রাট তবারক এখন পর্যন্ত অধরা থেকে যাওয়ায় নানা অস্বস্তি, আতংক ও উৎকণ্ঠা যেন সর্বত্র। যার ফলে তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে অব্যাহত লেখালেখি করছেন নেটিজেনরা। তাদের প্রশ্ন, মাদক নির্মূলে বর্তমান সরকার যেখানে শূন্য সহনশীলতা দেখাচ্ছে, সেখানে কুখ্যাত ইয়াবা সম্রাট তবারককে গ্রেপ্তারে কালক্ষেপন করা হবে কোন অদৃশ্য কারণে? তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করার পাশাপাশি সমূলে বিনাশ করে দিতে হবে তার ও তার স্ত্রীর গড়ে তোলা মাদক সাম্রাজ্য।সমাজ সচেতন ও মাদকবিরোধী নেটিজেনদের মধ্যে শহিদুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন ‘সারাদেশে এত মাদক ব্যবসায়ী ক্রসফায়ারে গেল, এই তবারক কেন গেলনা সেটা স্থানীয় প্রশাসন ছাড়া কেউ বলতে পারবেনা।’ লুৎফর রহমান নামে একজন লিখেছেন, ‘বিশ্বনাথের এত বড় ইয়াবা ব্যবসায়ী ব্যবসা চালাচ্ছে, প্রশাসন কি ঘুমে?’ ইয়াবা সম্রাজ্ঞী সাবিনা আক্তার গ্রেপ্তার হওয়ায় হবিগঞ্জের ডিবি পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিছবাহ উদ্দিন নামে একজন লিখেছেন, ‘দুঃখ হয় বিশ্বনাথের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বহু আগে থেকেই জানে এই লোক (তবারক) একজন টোকাই থেকে মাত্র কয়েক বছরে মাদক ব্যবসা করে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে এবং সবাই জানে সেটা সম্ভব হয়েছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে।’ আবদুল হান্নান নামে একজন লিখেছেন তবারক ও তার সঙ্গে যে চোরাকারবারী আছে, তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক।’ নেটিজেনদের এরকম পোস্ট আর কমেন্টে প্রতিনিয়ত সয়লাব হচ্ছে ফেসবুক। তাদের সকলের একটাই দাবি-দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে তবারককে।
কে এই তবারক?
পলিথিন-চানাচুর বিক্রেতা থেকে আন্তঃবিভাগীয় গাড়ি চোর চক্রের সদস্য। তারপর মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততা। সেখান থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি সিলেটের বিশ্বনাথের হতদরিদ্র পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান তবারক আলীকে। স্ত্রী সাবিনা আক্তারসহ পুরোদমে নেমে পড়ে ইয়াবা ব্যবসায়। গড়ে তুলে শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। মাদক সাম্রাজ্যে পরিচিত হয়ে উঠে ‘ইয়াবা সুমন’ নামে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অর্থ-বিত্তে বিলিয়নপতিতে পরিণত হয় সে। তার এই অর্থ-বিত্তের উৎস ও মাদক সাম্রাজ্য আড়াল করতে অবতীর্ণ হয় ‘কথিত’ দানবীরের ভূমিকায়। দান-দক্ষিণা পেয়ে অনেকেই ভক্ত হয়ে পড়েন তবারকের। অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিরাও ভক্ত হন তার কাছ থেকে বড় অংকের টাকা ঋণ নিয়ে। ফলে, স্বভাবতই এলাকায় প্রভাবের বিস্তার ঘটে ইয়াবা সম্রাট তবারকের। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ালেও ভয়ে-আতংকে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস দেখায় না।উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামের মৃত আলকাছ আলীর পুত্র ইয়াবা সম্রাট তবারক আলী ২০১০ সাল থেকে চুরি-ছিনতাইয়ে অভিযুক্ত হতে থাকলেও মূল আলোচনায় আসে ২০১১ সালে। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর বিশ্বনাথ থানা পুলিশ একাধিক চুরির মামলায় ২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসলে পরদিন বিকেল ৩টার দিকে হাতকড়াসহ থানা হাজত থেকে পালিয়ে যায় সে। পালিয়ে যাওয়ার ৭ ঘন্টার মধ্যেই তাকে আবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সে সময় থানা পুলিশের দুই সদস্য ক্লোজড হন। এ ঘটনার পর ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায় তবারক। বছর দেড়েক পূর্বে তার বাড়ির সামনে থেকে দু’জন অজ্ঞাতনামা নারীর লাশ উদ্ধার ও গ্রামের মসজিদ নিয়ে দু’ক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তবারকের মাদক সাম্রাজ্যের কাহিনী সামনে চলে আসে।২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে সাতটি মামলা ও দুটি জিডি দায়ের হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় দুটি মামলা ও দুটি জিডি দায়ের করা হয়। ওই বছরের ২৬ আগস্ট ৩৬(১) এর ১৯(ক) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন-২০১৮ অনুযায়ী থানার এসআই দেবাশীষ শর্ম্মা বাদী হয়ে তবারকসহ ৩ জনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা (নং ২৪, তাং ২৬.০৮.১৯ইং) দায়ের করেন। এ ঘটনায় বিশ্বনাথ-লামাকাজী সড়কের আমজদ উল্লাহ কলেজের সামনে থেকে আধা কেজি গাঁজাসহ তার স্ত্রী সাবিনা আক্তারের মালিকানাধীন সিএনজিচালিত অটোরিকশা (সুনামগঞ্জ-থ ১১-২০৬৭) জব্দ করে পুলিশ। পরে একই বছরের ২৪ অক্টোবর তবারককে অভিযুক্ত করে থানা পুলিশ সেই মামলার চার্জশিট আদালতে প্রেরণ করে। এ আগে, ওই বছরেরই ১৬ অক্টোবর সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে গ্রেপ্তারের দাবিতে রামপাশা ইউনিয়র পরিষদের চেয়ারম্যানসহ এলাকার প্রায় ৩ শতাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এই স্মারকলিপি প্রদানের আগে তবারকের পক্ষে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বারসহ এলাকার প্রায় শতাধিক ব্যক্তি স্মারকলিপি প্রদান করেন। এলাকাবাসীর দেয়া স্বারকলিপিতে স্বাক্ষর দেয়ায় ১৭ অক্টোবর পাঠাকইন গ্রামের ময়না মিয়ার পুত্র চুনু মিয়ার উপর হামলা করে তার তবারকের পক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় চুনু মিয়া বাদী হয়ে তবারকসহ ৭ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে মামলা (নং ১১, তাং ১৮.১০.১৯ইং) দায়ের করেন।এতকিছুর পরও দেদারছে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তবারক-সাবিনা। কিন্তু, গত ৫ ফেব্রুয়ারী রাত দেড়টার দিকে সিলেট থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এসআই আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশের একটি দল ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা মূল্যের ৬১ হাজার পিস ইয়াবাসহ ‘নাহিদা বেগম ও শাহিনা খাতুন’ নামের দুজন নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। ওই দু’জন ছিলেন তবারক-সাবিনার সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান সদস্য। আর গ্রেপ্তারের পর ডিবি পুলিশের হাতে জিজ্ঞাসাবাদে নাহিদা-শাহিনা হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশকে জানায়, তবারক ও তার স্ত্রী সাবিনার হয়ে তারা কাজ করে আসছে। আর তবারক-সাবিনা তাদেরকে (নাহিদা-সাবিনা) দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা বহন/বিক্রয় করে আসছেন। এ ঘটনায় হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশের এসআই আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীসহ তবারক ও সাবিনাকে অভিযুক্ত করে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৬ (তাং ৬.০২.২০ইং)। ওই রাতেই হবিগঞ্জ ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় ইয়াবা সম্রাজ্ঞী সাবিনা। ফের আলোচনা চলে আসে তবারক।জনশ্রুতি আছে, ইয়াবা সম্রাট তবারকের (নিজের বা আত্মীয়-স্বজনদের নামে) সম্পদের তালিকায় প্রায় ৫০ একর জমি, ৫টি হাইয়েস, ৩টি নোহা, ৩টি এলিয়েন কার, ৩টি বাস (ঢাকা-গাজীপুর সড়কে), ২টি ট্রাক, ১৬টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৭টি দোকান কোঠা এবং বিশ্বনাথসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ব্যাংকে তবারক বা তার স্ত্রী সাবিনা আক্তারের ব্যাংক একাউন্টগুলোতে বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে। এছাড়াও, বিশ্বনাথ উপজেলা সদরের পুরান বাজারের শরিষপুর গ্রামে তার ৫ তলা বিশিষ্ট একটি ও রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামে সরকারি সড়কের পাশের বেশকিছু গাছ কেটে ডুপ্লেক্স একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।কথা হলে বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) শামীম মুসা বলেন, শুধু তবারক কেন? মাদক ব্যবসায় সাথে যেই জড়িত থাকবে, তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।