মৌলভীবাজারে কমরেড আবদুল হক-এর ২৪-তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন

উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা কমরেড আবদুল হক-এর ২৪-তম মৃত্যুবার্ষিকী পালণ করা হয়েছে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ এর কার্যালয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সন্ধায়। এনডিএফ জেলা কমিটির সভাপতি শহীদ সাগ্নিকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাসের পরিচলনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহবায়ক অবনী শর্ম্মা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ জেলা কমিটির সভাপতি মোঃ নুরুল মোহাইমীন, ধ্রবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিঃ নং ২৪৫৩-এর সভাপতি সোহেল আহমেদ, মৌলভীবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিঃ নং চট্টঃ ২৩০৫ এর সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহিন মিয়া, চা-শ্রমিক সংঘের মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সদস্য চা-শ্রমিকনেতা নারায়ন গোড়াইত, হোটেল শ্রমিকনেতা তারেশ বিশ্বাস সুমন, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন কালেঙ্গা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মোঃ গিয়াস উদ্দিন ও রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন কুলাউড়া উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতি মোঃ মিজান মিয়া প্রমূখ। সভায় বক্তারা সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে বলেন- সমগ্র পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এক গভীর ও সামগ্রিক সংকট, দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বৃহত্তম ও গভীরতম অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দা আঁকাবাঁকা গতিপথে ১২তম বছরে পড়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। পুঁজি ও শক্তির অনুপাতে বাজার ও প্রভাববলয় পুণর্বন্টনকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মুদ্রাযুদ্ধ, স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধ বিস্তৃত হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করে চলছে। সাম্রাজ্যবাদীরা সংকটের বোঝা বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণি, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ায় দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম, বিদ্রোহ-বিপ্লব তথা বিশ্ববিপ্লবের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়ছে জাতীয় ক্ষেত্রে। বাজার ও প্রভাববলয় পুণর্বন্টন প্রশ্নে আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে বাংলাদেশসহ এতদাঞ্চলকে নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থল সংযোগ সেতু এবং প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের সংযোগকারী মালাক্কা প্রণালী সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেমন তার প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে চায় তেমনই সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও পুঁজিবাদী চীন তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদীরা স্বীয় স্বার্থে বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে চায়। সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা-দালাল পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শাণিত করে সাম্রাজ্যবাদী অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল শক্তি ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা। তাহলেই কেবল কমরেড আবদুল হকের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদস সম্ভব হবে। বক্তারা আরও বলেন- কমরেড আবদুল হক সংগ্রামী জীবনের উপর আলোকপাত করে বলেন ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর যশোর জেলার সদর থানার খড়কিতে এক সম্ভ্রান্ত সামন্ত পীর পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অথচ সেই সামান্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই তিনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সামন্তবাদী পীর পরিবার থেকে আগত হলেও তিনি যখন কলকাতায় পড়াশুনা করতেন সেই ছাত্রাবস্থায় তিনি ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং শ্রমিক এবং শ্রমিকশ্রেণীর মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈপ্লবিক কর্মকান্ড শুরু করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে বি.এ অনার্স পড়ার সময় তিনি ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রার্থী সভ্যপদ লাভ করেন। ১৯৪১ সালেই যশোর জেলার বনগাঁয়ে তৃতীয় কৃষক সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এই সম্মেলনে “লাঙ্গল যার জমি তার” এবং ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাকিন্তান আমলে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পুর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশের সময়কালে তিনি ১৯৩৯ সালে হলওয়ের মনুমেন্ট ভাঙ্গার আন্দোলন, ১৯৪২ সালে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন, হাটের তোলা আদায় বন্ধ আন্দোলন, ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন ও গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭১ এ যুদ্ধ ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন ইত্যাদি। এই সাম্রগ্রিক সময়কালে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে অগ্রণী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। কমিউিনিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সংশোধনবাদের সকল প্রকাশের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের লাল পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম থেকেই আদর্শগত সংগ্রাম চালান। সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ চক্রের বিরুদ্ধে এই আদর্শগত সংগ্রামের সঠিকতা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট। ‘সমাজতন্ত্র ব্যর্থ’ সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের এই প্রচার অভিযানের ঝড় যখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কালজয়ী ভাবাদর্শ উৎপাটিত করতে প্রবাহিত তখন কমরেড আবদুল হক একজন দৃঢ় মাকর্সবাদী-লেনিনবাদীর মত অটল অবিচল ছিলেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবী আশাবাদ ও তৎপরতায় উজ্জল। কমরেড আবদুল হক ছিলেন সুবক্তা। তাঁর উদ্দীপক বক্তৃতা প্রতিটি জনসভাকে উদ্দীপ্ত করত। ১৯৭০সালের ২০ জানুয়ারী আসাদ দিবসে ভাসানী ন্যাপ আয়োজিত ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।