সময়টা ১৯৫৭ সাল। তখন আমি পাবনা রাধানগর মজুমদার একাডেমীর তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। হঠাৎ একদিন ফর্সা, সুদর্শন একটি ছেলে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হল। আমি, তারা, বাবু, মুক্তার. খসরু তখন প্রাণের বন্ধু। ১৯৫৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির পর থেকে সব সময় আমরা একই বেঞ্চে বসতাম। ডানপিটে দুষ্টু ছেলের দল হিসেবে পরিচিতিও ছিল আমাদের। হঠাৎ করেই তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ছেলেটা এসে আমাদের বেঞ্চে বসে পড়ল। নতুন ছেলেটার এমন কাজে আমাদের প্রেস্টিজ যায় যায় অবস্থা। তিন জনে মিলে দিলাম পিটুনি। পরদিন কেড়ে নিলাম টিফিনও । এরপরও সেই ছেলেটা গোয়ার্তুমি করে আমাদের সাথেই বসে। যেন জোর করেই আদায় করবে সবকিছু। একপর্যায়ে আমাদের হার মেনে নিতেই হল। আমরা বাঁধা পড়ে গেলাম বন্ধুত্ব নামের এক নিঃস্বার্থ,ভালোবাসার বন্ধনে। শৈশবের ডানপিটে দুরন্তপনার মাঝে খুঁজে পাওয়া আমার সেই বন্ধুটির নাম সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। বর্তমানে ইসলামী ব্যাঙ্কের ভাইস চেয়ারম্যান। বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক দুদক কমিশনার ও বিচারক।
১০ ডিসেম্বর । সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর ৭১ তম জন্মদিন। অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময় ধরে চেনা এই প্রাণের বন্ধুর জন্য রইল জন্মদিনের শুভেচ্ছা । শুভকামনা। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর পাশাপাশি কামনা করি সামল্যময় আগামী।
শৈশব, কৌশরের দুরন্তপনা, উত্তাল যৌবনে ছাত্র রাজনীতি, আন্দোলন,সংগ্রাম, কর্মজীবন শেষে এখন আমাদের পড়ন্ত বেলা। জীবনের বালুকাবেলায় হারিয়ে ফেলেছি অনেক বন্ধুকে। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় মান্নাদের সেই কালজয়ী গানে তাই আজ চোখ অশ্রæ সজল হয়।
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই।
সোনালী সময় হারালেও আমাদের আ্ড্ডা কিন্তু বেঁচে আছে আজও। সেসব আড্ডাতেও মধ্যমনি হয়ে থাকে চুপ্পু। তাই, পাবনা অথবা ঢাকা যেখানেই দেখা হোক না কেন। বেবী, তারা, মুক্তার, বুড়ো, চুপ্পু আর আমি এক হলেই আজও তাই ফিরে যাই সেই শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের স্বর্ণালী দিনগুলোতে। এই দীর্ঘ পথচলায় এতটুকুও বদলায়নি আমাদের প্রাণের টান। জোর করে ভালবাসা আদায় করার যেন এক অসীম ক্ষমতা দিয়েই ওকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ¯্রষ্টা। সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছেও যে, একদিনের জন্যও ভুলে যায়নি শৈশবের বন্ধুদের। শত ব্যস্ততায়, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাঝেও নিয়ম করে খোঁজ নিয়েছে সবার। পাশে দাঁড়িয়েছে আপদে,বিপদে।
চুপ্পুকে নিয়ে লিখতে বসে এলোমোলো কত স্মৃতি এসে মনে দোলা দিচ্ছে। কি লিখবো আর কি বাদ দেব, বুঝতে পারছি না। সোনার খাঁচায় সত্যিই ধরে রাখা যায়না সোনালী স্মৃতি। স্মৃতির পাতায় তা যেন এক একটি হীরে বসানো সোনার ফুল।
স্কুল জীবন শেষে আমরা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হলাম। জড়িয়ে পড়লাম ছাত্র রাজনীতিতে। চুপ্পু যোগ দিল ছাত্রলীগে আমি ছাত্র ইউনিয়নে। রাজনৈতিক আদর্শের পার্থক্য হলেও আমাদের বন্ধুত্বে কোন ছেদ পড়েনি। বাঙালীর স্বাধীকার আদায়ের লড়াইয়ে একই সাথে আমরা অংশ নিয়েছি ভুট্টা আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, ছাত্র সমাজের ১১ দফা আন্দোলনে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি একই সাথে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
ছোটবেলা থেকেই চুপ্পু প্রচন্ড সাহসী,দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রশ্নে আপোসহীন। ভয় ভীতি কিংবা প্রলোভন কিছুই তাঁকে কখনো তাঁর অবস্থানচ্যূত করতে পারেনি। এই প্রশ্নে আজও সাহাবু্িদ্দন হিমালয়ের মত অটল, অবিচল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় গোটা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমন শুরু করে। সে সময় পাবনায় হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ২৯ মার্চ কোন ধরণের সামরিক বাহিনীর সহযোগীতা ছাড়াই কেবলমাত্র পাবনার বিপ্লবী ছাত্র জনতার আক্রমণে পাবনা জেলায় আসা সব পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ২৯ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত হানাদার মুক্ত ছিল গোটা পাবনা জেলা।
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আমজাদ হোসেন এমএনএ’র নেতৃত্বে আব্দুর রব বগা মিয়া এমপিএ, অ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন এমপিএ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ, তফিজউদ্দিন আহম্মেদ এমপিএ, মোজাম্মেল হক সমাজী এমপিএ, কমরেড প্রসাদ রায় (কমিউনিস্ট পার্টি), আমিনুল ইসলাম বাদশা (ন্যাপ-মোজাফফর), অ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, ওয়াজিউদ্দিন খান, গোলাম আলী কাদেরীসহ মোট ৩১ সদস্যের একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মধ্য শহরের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়। এই সংগ্রাম কমিটিই ছিল পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের হাইকমান্ড।
পাশাপাশি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা গোপনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে প্রস্ততি নিয়েছিলেন। পাবনা জেলা সংগ্রাম কমিটির নির্দেশনা ও ছাত্রনেতাদের ব্যবস্থাপনায় ১২ মার্চ থেকে পাবনা জেলা স্কুল মাঠে ও পুরাতন পলিটেকনিক মাঠে ছাত্র যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের কার্যক্রম শুরু হয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রমে চুপ্পু দারুণ ভাবে সক্রিয় ছিল।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাক হানাদার বাহিনী পুনরায় পাবনা দখল করে নিলে আমার বড় ভাই মরহুম আমিনুল ইসলাম বাদশার সাথে আমি, চুপ্পু ও প্রয়াত শিরিন বানু মিতিল ভারতের কেঢ়ুয়াডাঙা শিবিরে প্রশিক্ষণের জন্য যাই। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে অংশ নেই।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ছাত্রলীগের জেলা সভাপতির দায়িত্ব পান। লম্বা চুলের সুদর্শন যুবক আর সুবক্তা হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা ছিল তাঁর। রাজনৈতিক সমাবেশে চুপ্পুর বক্তব্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুও। কাছে ডেকে স্বভাব সুলভ আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলেন চুপ্পুকে। হেলিকপ্টারে ঢাকায়ও সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে।
১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পাবনায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুরা মিলে প্রতিরোধ যুদ্ধের পরিকল্পনা করি। কিন্তু, পরিস্থিতি ছিল চরম প্রতিকূল। আমরা কয়েক জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় চুপ্পু। দিনের পর দিন জেল খানায় চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও সেদিন, তাকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে তিল পরিমাণ নড়াতে পারেনি তৎকালীন সরকার।
কর্মক্ষেত্রেও বহুমাত্রিক সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। বাংলার বাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা, আইনজীবী, বিচারক হিসেবে কাজ করে রেখেছেন যোগ্যতার স্বাক্ষর।
সর্বশেষ, দুদকের কমিশনার হিসেবে পদ্মা সেতু বিতর্কে চরম ঝুঁকি নিয়েও বিশ^ব্যাঙ্ক ও প্রভাবশালী নানা শক্তির চাপ উপেক্ষা করে সত্যের প্রশ্নে অটল থেকে পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ করেছেন। যার স্বীকৃতি মিলেছে কানাডার আদালতেও। দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংসের সুগভীর ষড়যন্ত্রের ছ্ক যারা একেছিল তাদের মুখে চুনকালি লেপে দিতে এক মুহুর্তও দ্বিধা করেনি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
এমন দেশপ্রেমিক বন্ধুকে নিয়ে কার না গর্ব হয়। সাফল্যের সব রাজমুকুট তো তোমারই প্রাপ্য। শুভ জন্মদিন বন্ধু আমার। লেখক, সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।