মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতিপরিচিত। খাবার প্লেটে মাছের তরকারী না থাকলে রুচির সাথে পেটপুরে খাওয়াই অসম্পূর্ন থেকে যায়। তেমনি চলনবিলের সুস্বাদু মাছের কথা মনে পড়লে অনেকের লোভ সামলানো কঠিন হয়ে যায়। সেই মৎস্য ভান্ডার খ্যাত নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নওগাঁর আংশিক অংশ নিয়ে গঠিত দেশের বৃহৎ চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শত প্রজাতির সুস্বাদু ছোটবড় মাছ। জেলে মৎস্যজীবিরাতো মাছের অভাবে পৈত্রিক পেশা ছেড়ে বিকল্প আয়ের সন্ধানে স্থানান্তর হচ্ছেন। তাদের পেশা দখল করে নিয়েছে নব্য মৎস্য চাষীরা। চাহিদা মেটানোর জন্য বানিজ্যিক ভিত্তিতে চলছে উন্নত জাতের মাছের চাষ। অধিক লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা ফসলের আবাদ ছেড়ে কৃষিজমি ধংস করে মাছ চাষের জন্য পুকুর খননের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। একের পর এক পুকুর গিলে খাচ্ছে খাদ্য উৎপাদনের কৃষকের একমাত্র অবলম্বন মূল্যবান কৃষিজমি। প্রশাসনিক কঠোরতাও দমাতে পারছেনা পুকুর খননের মহামারী মাদকতা।
এদিকে চলনবিলের প্রাণকেন্দ্র নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় সরকারি পুকুরের সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার। যার জলায়তন ২ হাজার ৫শ হেক্টর। পুকুরে চাষকৃত মাছের উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার মেট্রিকটন। বেসরকারী হিসেবে পুকুর, জলায়তন এবং মাছের উৎপাদনের পরিমান আরো বেশি হবে বলে মাঠ পর্যবেক্ষনে জানা গেছে।
এছাড়া উপজেলায় সাড়ে ৬ হাজার পুকুরসহ ৯টি নদী, ৬টি বিল, ৩টি খাল এবং ৩০টি প্লাবন ভূমিসহ ৬ হাজার ৫শ হেক্টর জলায়তনে মাছের উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার মেট্রিকটনের বেশি। উপজেলায় মোট জনসংখ্যা অনুপাতে অভ্যন্তরীন মাছের চাহিদা ৫ হাজার ৪৭০ মে.টন। উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে দ্বিগুনেরও বেশি। উদ্বৃত্ত মাছ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে মাছ চাষীরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। দশ বছর আগেও (২০০৮-২০০৯ সালে) পুকুর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১১টি, জলায়তন ছিল ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর, মাছ উৎপাদন হতো ৬ হাজার ১১০ মে.টন। সেই হিসেবে দশ বছরে উপজেলায় মাছের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশী।
জেলা মৎস্য অফিসের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তথ্যমতে, পুকুরে মাছ চাষে জেলার গুরুদাসপুরে পুকুরে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ ৯ হাজার ১০৩ মে.টন। আর নাটোরে ৮ হাজার ৫৫ মে.টন, সিংড়ায় ৮ হাজার ১৬৬ মে.টন, বড়াইগ্রামে ৪ হাজার ৭৬৫ মে.টন, লালপুরে ৩ হাজার ৬৩ মে.টন, বাগাতিপাড়ায় ১ হাজার ৬৫০ মে.টন এবং নলডাঙ্গা ২ হাজার ৬৪০ মেট্রিকটনসহ জেলায় ৩৭ হাজার ৪৪২ মে.টন মাছ উৎপাদন হয়। বেসরকারি হিসেবে গুরুদাসপুর উপজেলায় এর পরিমাণ আরো বেশি হবে বলে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার দাবী করেন।
উপজেলা মৎস্য অফিসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মৎস্য চাষীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১১২ জন। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার। এক বছরেই মাছ চাষীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ হাজার। এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। যা কৃষি জমি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর কবীর বলেন, তাই চলনবিল তথা গুরুদাসপুরের মানুষের মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমান বেড়েছে কয়েকগুন। পুকুরে মাছ চাষ বেড়ে যাওয়ায় দশ বছর আগের তুলনায় বাজারে মাছের আমদানি বেড়েছে। সেই সাথে দামও তুলনামূলক কম।
তিনি আরও বলেন, মাছ উৎপাদনে নাটোর জেলায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে গুরুদাসপুর। জনবলের অভাবে উপজেলায় প্রকৃত পুকুরের সঠিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। সঠিক তথ্য জরিপের জন্য লোক নিয়োগের জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে পুকুরে মাছ চাষে গুরুদাসপুর উপজেলা প্রথম অবস্থানে আছে।