মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে জেলা প্রশাসক (ডিসি)। ডিসি জেলার শীর্ষপদ। সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪ জন ডিসি রয়েছেন। তাদের মধ্যে নারী রয়েছেন আট জেলায়। জেলা প্রশাসক পদে দায়িত্ব পালন করা আট নারী হলেন, কুড়িগ্রামে মোছা. সুলতানা পারভীন, পঞ্চগড়ে সাবিনা ইয়াসমিন, মৌলভীবাজারে নাজিয়া শিরিন, নড়াইলে আনজুমান আরা, শেরপুরে আনার কলি মাহবুব, গোপালগঞ্জে শাহিদা সুলতানা, রাজবাড়ীতে দিলসাদ বেগম ও নরসিংদীতে সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন। তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে প্রশংসিত হচ্ছেন।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোছা. সুলতানা পারভীন গত বছরের মার্চে সেখানে যোগদান করেছেন। তিনি সেখানে তৈরি করেছেন স্বপ্নপুরী। স্বপ্নপুরীতে তরুণ তরুণীরা আসে তাঁদের স্বপ্নের কথা জানাতে, স্বপ্ন পূরণের পথ খুঁজতে। বড় কক্ষটি জুড়ে আছে ২০টি ল্যাপটপ, গ্রন্থাগার, মহামানবদের নানা ছবি ও বাণী, বিভিন্ন দেশের মানচিত্র। এখানে তরুণেরা পড়েন, ইন্টারনেটে সার্চ করে, বিভিন্ন প্রোগ্রাম শেখে, নিজেরা কথা বলে। এখানে শুধু শিক্ষিত তরুণ তরুণী নন, রিকশাচালক থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের মানুষদের নিয়েও কর্মশালা হয়। সমস্যার কথা শোনা হয়। একেক জনের ভেতরে যে সম্ভাবনা আছে, সেই সম্পর্কেও জানানো হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কাছেই চার একরের একটি মজাপুকুর ছিল। এটি ছিল মাদকসেবীদের আড্ডা। নিজ উদ্যোগে এ পুকুর পুনঃখনন করেছেন। পাড় বাঁধানো হয়েছে। এখন সকাল বিকেল মানুষ এখানে হেঁটে বেড়ায়। জায়গাটি বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, জেলা প্রশাসক হিসেবে দাপ্তরিক যে দায়িত্ব সেটা তো আমার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব প্রাপ্ত অন্যরাও করতে পারেন। কিন্তু একজন ডিসি হলেন চেঞ্জ মেকার। তাঁকে অবশ্যই পরিবর্তনে ব্রতী হতে হবে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের তৈরি স্বপ্নপুরীর মতো বর্তমানে দেশের যে ৮ জেলায় নারী জেলা প্রশাসক (ডিসি) আছেন তাদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ স্থানীয় ভাবে প্রশংসিত হচ্ছে।
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন। বাবা শেখ মাহতাব উদ্দিন যখন যুদ্ধে যান, সাবিনা ইয়াসমিন তখন মাতৃগর্ভে। সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম হলো, দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু নবীন দেশ আর ঔরসজাত সন্তানের মুখ দেখতে পেলেন না মাহতাব উদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। বাবার বীরত্বের গল্প শুনতে শুনতে বড় হওয়া সাবিনা ইয়াসমিন পঞ্চগড় জেলার প্রতিটি স্কুল কলেজ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে একটি করে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার করেছেন নিজ উদ্যোগে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বইয়ের পঠন পাঠন, কুইজ প্রতিযোগিতা।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে গৌরবের বিষয়। নতুন প্রজন্ম সেই ঘটনাকে হৃদয়ে ধারণ করুক, এটাই লক্ষ্য। স্কুল কলেজে যদি এর পঠন পাঠন থাকে, তবে একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে সেই আদর্শ নিয়ে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিনের ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য পরিষেবা স্থানীয় মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। পাথর ভাঙার শ্রমিক, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং দরিদ্র মানুষ এই সুবিধা পায়। জেলা সিভিল সার্জন ও অন্যরা এতে সহযোগিতা করেন। সপ্তাহের একটি দিন জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে এ দল পৌঁছে যায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে।
গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রেণি বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের কাছে যান মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন। এর আগে নীলফামারীর জেলা প্রশাসক ছিলেন তিনি। গত জুনে যোগ দিয়েছেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন চা বাগানের এ জেলায়।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, অনেক সময় আমাদের কাজের সিদ্ধান্ত হয় ওপর থেকে। যাদের জন্য কাজ, তাদের কথা শোনা হয় না। তাই মানুষের কাছে যাই।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক আনজুমান আরার বিশ্বাস করেন, কোনো মাধ্যম ব্যবহার না করে সরাসরি মানুষের সমস্যা জানা গেলে সমস্যার প্রকৃত স্বরূপ জানা যায়। নড়াইলের জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, আমাদের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ এখনো ততটা সচেতন না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সচেতনতার বার্তা দিই।
বর্তমানে প্রতি জেলায় উন্নয়ন মেলা হয়। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন এই উন্নয়ন মেলায় জব কর্নার করেছেন। সেখানে চাকরি প্রার্থীরা তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। গত বছর থেকে এ উদ্যোগ শুরু, এ পর্যন্ত ৪০০ তরুণ চাকরি পেয়েছে।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব দায়িত্ব নেওয়ার পর গজনীর অবকাশ কেন্দ্র উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা দায়িত্ব নিয়েছেন মাস তিনেক হলো। প্রথমেই জেলার প্রায় সব সাংবাদিকের সঙ্গে বসে জেলার সমস্যা শুনেছেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের অনেকেই বলেছেন, এ ভাবে উদ্যোগী হয়ে সমস্যার কথা শোনার রেওয়াজ ছিল না।
দুই মাস হলো রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক হয়েছেন দিলসাদ বেগম। জেলার নদী ভাঙন রোধকে প্রাধান্য দিচ্ছেন শুরু থেকেই। জেলার বিনোদন কেন্দ্র ও পার্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রাথমিক শিক্ষকেরা যাতে ডিজিটাল সামগ্রী ব্যবহার করতে পারেন, সে বিষয়েও যত্নবান হবেন বলে জানালেন এ জেলা প্রশাসক।
উল্লেখ্য, জেলা পর্যায়ে ডিসি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসি জেলার সাধারণ প্রশাসনিক কার্যক্রম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং কালেক্টর হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলো দেখে থাকেন। এ ছাড়া নির্বাচিত সরকারের বিশেষ কর্মসূচি এবং চলমান সব উন্নয়নমূলক কাজে জেলা প্রশাসক তদারকি করে থাকেন।
সাধারণত নির্দিষ্ট সময় উপসচিব হিসেবে থাকার পর ফিটলিস্টভুক্ত এবং সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে (এসএসবি) নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন সাপেক্ষে কাউকে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়।
জেলা প্রশাসক যেকোনো বিষয়ে যেকোনো মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকারের নজরে আনার অনুরোধ বা অবগতি করতে পারেন।