অপরাধীদের সখ্যতায় অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ওসি ওবাইদুল

ষ্টাফ রিপোর্টার ঃ
মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সাথে সখ্য গড়ে তাদের মাধ্যমে অর্থ বিত্তের পাহাড় গড়াই ছিল পাবনা সদর থানার প্রত্যাহার হওয়া ওসি ওবাইদুল হকের নেশা। তার প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা একের পর পর এক অপরাধ করলেও বরাবরই থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। খুন,ধর্ষণ,মাদক কারবার কিংবা যে অপরাধই হোক না কেন সন্ত্রাসীদের মধ্যস্থতায় টাকার বিনিময়ে সব কিছুরই সমাধানদাতা ছিলেন ওসি ওবাইদুল।
সম্প্রতি, পাবনায় তিন সন্তানের জননী এক নির্যাতিতা গৃহবধুর দায়ের করা গণধর্ষণের অভিযোগ থেকে শরিফুল ইসলাম ঘন্টু নামের এক আসামীকে বাঁচাতেই সদর থানা চত্বরে বিয়ের আয়োজন করেন ওসি ওবাইদুল হক। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের অভিযোগ, শরিফুল ইসলাম ঘন্টু সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও সদর থানায় ওসি হিসেবে ওবাইদুল হক ২ বছর আগে যোগদানের পর থেকেই এলাকায় তার দাপট বেড়ে যায়। সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও সালিশ বাণিজ্য করলেও তাকে থামাতে পারেন নি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারাও। ওসির সাথে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি এলাকায় ওপেন সিক্রেট হওয়ায় নির্যাতিত হয়েও ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দিতে সাহস করে নি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ঘন্টুর মাধ্যমে ওসি ওবাইদুল হক নিয়মিত মাসোহারা নিতেন। তাদের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, দাপুনিয়া এলাকায় কমিউনিটি পুলিশিংসহ, জেলা পুলিশের যে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বও পড়ত ঘন্টুর কাঁধেই। বুধবার গণধর্ষণ মামলায় ঘন্টু গ্রেফতার হলে ঘন্টুর সাথে ওসি ওবাইদুল হকের একাধিক ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
সূত্রমতে জানা গেছে, গত ২৯ আগস্ট রাতে অপহৃত হবার পর টানা কয়েকদিন টেবুনিয়া সিড গোডাউন এলাকায় ঘন্টুর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে গণধর্ষণের শিকার হন এক নারী। পরে, ৫ সেপ্টেম্বর রাতে ওই নারী ঘন্টুসহ ৫ জনকে আসামী করে থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়। বিষয়টি জানাজানি হলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হতে ওসি ওবাইদুল হককে ফোন করলে তিনি অভিযোগ পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন। পরে, মামলা নথিভুক্ত না করে থানায় অভিযুক্ত এক ধর্ষক রাসেলের সাথে ওই নারীকে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ ওঠে ওসির বিরুদ্ধে। ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় বৃহঃস্পতিবার ওসি ওবাইদুল হককে পুলিশ লাইন রিজার্ভ অফিসে প্রত্যাহার করা হয়।
দাপুনিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর খান বলেন, দল ক্ষমতায় আসার পর শরিফুল ইসলাম ঘন্টু গত ৪/৫ বছর পূর্বে সৌদি আরব থেকে ফিরে এসে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। অল্প দিনের মধ্যেই নিজস্ব বাহিনী তৈরী করে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেন। কেউ ঘন্টু বাহিনীর অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই তাকে ্ওসির মাধ্যমে মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করা হত। আমরা বলেও তাকে সংশোধন করতে পারি নি।
সরেজমিনে ওই এলাকায় ঘুরে ঘন্টু বাহিনীর অপকর্মের সত্যতাও মিলেছে। তবে ভয়ে নাম প্রকাশ করে কেউ বক্তব্য না দিলেও ওসি ওবাইদুল হকের সাথে ঘন্টুর বিশেষ সম্পর্কে বিষয়টি স্বীকার করেন।
অভিযোগ রয়েছে কেবল ঘন্টুই নয় সদর থানার বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, হত্যা মামলার আসামী ও মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতার সম্পর্ক ছিল ওসি ওবাইদুল হকের। এসব সন্ত্রাসীরা নিয়মিত তাদের ফেসবুক পেইজে ওসির সাথে আন্তরিক মুহুর্তের ছবিও পোস্ট করতেন। থানায় বিয়ের ঘটনায় ওসি বেকায়দায় পড়লে তারা ওসিকে নির্দোষ দাবি করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। অনেকে গণমাধ্যমকর্মীদের ফোন দিয়ে ভয়ভীতিও প্রদর্শন করে।


রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পাবনার ১৪ টি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের নিকট থেকে মাহবুব ও আতিক নামের দুই ব্যক্তির মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা করে মাসোহারা নিতেন ওসি ওবাইদুল। এছাড়াও সদর উপজেলার একটি বালিমহাল নিয়ন্ত্রক ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রতি মাসে দুই লক্ষ টাকা, মহেন্দ্রপুর এলাকার মাদক ব্যবসায়ী স¤্রাটসহ বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা তুলতেন। রাজশাহীর উপশহরে ওসি উবাইদুলের ছয়তলা বিশিষ্ট প্রাসাদপ্রম অট্টালিকা রয়েছে। সম্প্রতি, ২৬ লক্ষ টাকা দিয়ে পরিবারের ব্যবহারের জন্য একটি প্রাইভেট কারও কিনেছেন। তিনি ৮৪ হাজার টাকা দামের হাতঘড়ি, ৪২ হাজার টাকা মূল্যের চশমার ফ্রেমও ব্যবহার করেন। ব্যক্তিগত স্মার্টনেস এর দম্ভ করতে এসব নিয়ে প্রকাশ্যে বাহাদুরীও দেখাতেন তিনি।
এসব অপকর্মের বিষয়ে তদন্ত চলছে জানিয়ে পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম পিপিএম বলেন, ্ওসি ওবাইদুলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলমান। আপাতত তাকে পুলিশ লাইনের রিজার্ভ অফিসে প্রত্যাহার করা হয়েছে । তদন্ত রিপোর্ট পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।