বাল্যকালের ঈদ আনন্দ

এবাদত আলী

ঈদ শব্দের অর্থ হলো খুশি। আর ঈদের খুশির আমেজ ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে যেমন, বড়দের বেলায় ঠিক ততটা নয় বলেই মনে হয় । ছেলেবেলার ঈদ আনন্দের কথা ভাবতে গিয়ে বার বার সে সব স্মৃতিই মনে পড়ে ।
পঞ্চাশের দশকের কথা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোরগোড়া তখনো ডিঙানো হয়নি । ঈদ এলে দেশময় পাড়া ময় ছড়িয়ে পড়ে ঈদের আমেজ।
ঈদ এলে প্রায় সকলের জন্যই নতুন জামাকাপড় চাইই চাই। ছেলেদের জন্য পাজামা পাঞ্জাবি আর মেয়েদের জন্য রকমারি পোষাকের প্রচলন ছিলো তখনো। তার সাথে আলতা কুম কুম আর হিমানী পাউডারের ব্যবহার ছিলো সমান তালে ।
ঈদুল আযহার সময় পাড়ায় মহল্লায় তথা আমাদের বাড়িতে ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়তো। গ্রামের লোকদের মাঝে কোরবানীর পশু কেনার ধুম পড়ে যেতো । আমাদের বড়িতে এব্যবস্থাটা প্রতি বছরই পাকা পোক্ত করা থাকতো। অর্থাৎ গরুর পালের পাশাপাশি ছাগল পালনেরও ব্যবস্থা ছিলো। জমিচাষের জন্য হাল বওয়া কামলাদের মাঠে ভাত নেওয়ার জন্য যে ছেলেটি পেটভাতা হিসাবে কিংবা অতি সল্প বেতনে কাজ করতো, ছাগল দেখা শোনার দায়িত্ব বরাবর তার উপর ন্যাস্ত থাকতো । আব্বা আম্মার ইচ্ছায় প্রায় প্রতিবছরই দুটি ছাগল পালন করা হতো । একটি কোরবানীর জন্য অপরটি বিক্রয়ের জন্য। বিক্রয়লব্ধ টাকা দিয়ে ঈদের কেনা কাটার বাড়তি সুবিধা হতো । গ্রামের অনেকেই এ ধরনের ব্যবস্থা করতো। যারা গরু কোরবানী করতো তারা হারি চাঁদা তুলে সাত ভাগে কোরবানী দিতো । জিলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখা দেওয়ার পর হতেই কোরবানী পশুর সাজ সজ্জা চলতো । গরু ছাগল কিংবা ভেড়ার গলায় লাল ফিতা বেঁধে দেয়া হতো যাতে কোরবানীর পশু বলে সহজেই চেনা যায় । রঙিন কাগজের মালা গেঁথেও গরু ছাগলের গলায় পরানো হতো ।
ঈদের কদিন আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি ঠেঁকিতে আতপ চাউলের গুঁড়া তৈরির ধুম পড়ে যেতো । ঈদে মেয়ে জামাই আত্মীয় কুটুম যারা আসবে তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরির জন্যই আতপ চাউলের গুঁড়ার ব্যবস্থা করা হতো । তখন গোস্ত রুটি আর হাতে প্রস্তুত কৃত সেমাইয়ের প্রচলন ছিলো খুব বেশি। চাউলের গুঁড়া গরম পানিতে গুলিয়ে খামির তৈরি করে তা পিঁড়ির উপর রেখে হাতের তালুর সাহায্যে সেমাই প্রস্তুত করা হতো । স্থানীয় ভাষায় একে বলা হতো সেমাই বা ছই । এই সেমাই রোদে শুকিয়ে তা তুলে রাখা হতো। ঈদের দিন সকালে খেজুরের কিংবা আখের গুড় ও গরুর খাটি দুধ দিয়ে তা পাক করা হতো । এদিন আমাদের বাড়িতে সেমাই ও পোলাও সহ ভালো খাবারের ব্যবস্থা হতো ।
ঈদের আগের রাতে আমাদের ভালো করে ঘুম হতোনা । কখন যে রাত পোহাবে এই আশায় হৃদয় মন রোমাঞ্চে ভরপুর থাকতো ।
ঈদের দিন সকালে গোসল সেরে পাজামা আচকান বা শেরওয়ানী পরতাম । মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ নামক টুপি এবং পায়ে চপ্পল পরতাম । অনেকে ঝুলওয়ালা টার্কিশ টুপি পরতো । কাপড়ের তৈরি কিস্তি ও পাঁচকলিদারি টুপিরও প্রচলন ছিলো । বৃদ্ধ বয়সের লোকেরা কলিদারি পাঞ্জাবি, জোব্বা ও টুপি পরতেন এবং লাকড়া লাগানো খড়ম পায়ে চটর মটর শব্দে ঈদগাহের পথে চলতেন ।
জামা কাপড় পরা শেষ হলে বড় বোন আমার চোখে সুরমা লাগিয়ে দিতেন এবং আব্বা তুলায় করে আতর দিতেন যা দু কানের লতির কাছে গুঁজে রাখতাম । বাড়ি থেকে ঈদগাহের দুরত্ব ছিলো ঢের । রোদের তাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রায় সকলেই ছাতা মাথায় দিতো এবং দিন মজুরেরা মাথায় লালগামছা জড়িয়ে নিতো ।
পদ্মা নদীর শাখা মলম বেপারির কোল এর পাশে ছিলো কৈটাপাড়া গ্রামের ঈদগাহ মাঠ । ঈদগাহের মাঠ জুড়ে বড় বড় আম গাছের ঝাঁকড়া ডাল পালার নিচে গিয়ে সকলে বাঁশের খলপা বা চাটাইয়ের উপর বসতো । সামনের দিকে দু একটা কাতারে চটের ব্যবস্থা থাকতো । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজ পতি বা গ্রামের মাতব্বর শ্রেনীর লোক -দু একজন হাজী কিংবা অতি বয়স্ক ব্যক্তি চটের উপর বসতেন ।
শিবপুর কদম বগদীর (পাবনা জেলার আটঘরিয়া থানাধীন) মওলানা আবদুল্লাহ হুজুর ঈদে নামাজ পড়াতেন এবং নামাজ শেষে উচ্চস্বরে সুর করে খুতবা পাঠ করতেন। তখন মাইকের ব্যবহার সবেমাত্র শুরু হয়েছে । বিয়ে এবং সুন্নতে খাতনার গোসলের দিন গ্রামের অবস্থাপন্ন লোকেরা কলেরগানের সাথে মাইক বাজাতো । ঈদগাহ কমিটির পক্ষ থেকে ঈদের মাঠে খোতবা শোনার জন্য মাইক আনতে চাইলে মওলানা সাহেব অনুমতি দিতেননা । তিনি বলতেন – যে মাইকে কলের গান বাজানো হয় সেই মাইক দ্বারা নামাজের আজান দেওয়া , ওয়াজ নছিহত সহ খুতবা পাঠ করা না জায়েজ । এতে কষ্ট তারই বেশি হতো । প্রচুর সংখ্যক লোককে খুতবা ও ঈদের মাসলা মাসায়েল শোনাতে গিয়ে তাঁর কন্ঠনালীর রগ টান টান হয়ে উঠতো । নামাজ শেষে কোলা কুলি চলতো । বাড়ি ফিরে মুরুব্বিদেরকে কদমবুচি করতাম । মুরুব্বিগণ পিঠে হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন । কদমবুচি করলে বকশিশ মিলতো।
এক সময় কোরবানীর গরু ছাগলগুলোকে সমাজের প্রধান বা গ্রামের মাতব্বরের বাড়িতে নেওয়া হতো । তার আগে কাঁচা হলুদ বেঁটে পানিতে গুলিয়ে তা দিয়ে কোরবানীর পশুকে গোসল করানো হতো । জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত মোল্লা ধারালো ছুরি হাতে মাতব্বরের বাড়িতে উপস্থিত হতেন । পায়ে হেঁটে হেঁটে এ গ্রাম- সে গ্রাম মোল্লাকে পশু জবাইয়ের জন্য যেতে হতো ।
ঐ সকল মোল্লা জবেহ করা কোরবানীর পশুর মস্তক বা কল্লা নিয়ে যেতেন। সে সময় ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা- দীক্ষার দারুন অভাব ছিলো । পরবর্তীকালে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় মোল্লাগণের ভাগ্যে আর কোরবানী পশুর কল্লা জুটতো না ।
পশু কোরবানী শেষে কোরবানী পশুর চামড়া ছড়িয়ে ফেলা হতো ।এ কাজে গ্রামের দিন মজুরেরা ধনীদের গরু ছাগল ছড়ানোর কাজে সাহায্য সহযোগিতা করতো। বিনিময়ে তাদেরেকে অতিরিক্ত কিছু গোশ্ত দেওয়া হতো। এলাকার নিশি (মুচি) বা বেতুয়াগণ এসে গরু-খাসির চামড়া অতি সল্প মূল্যে ক্রয় করে নিয়ে যেতো । অনেকেই কোরবানী খাসির চামড়ায় লবন দিয়ে রাখতো । শুকিয়ে গেলে তা দিয়ে জায়নামাজ তৈরি করতো । কেউ কেউ আবার খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজে মাজায় দড়ি ঝুলানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করতো । ছেলেরা পশুর এক ধরনের পাতলা পর্দা মাটির হঁড়ি পাতিলের কাঁদার সাথে যুক্ত করে ঢোল জাতীয় এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতো তাতে হলুদের গুঁড়া মাখিয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে পর্দাকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করা হতো ।
গোশ্ত ছড়ানোর পর তা ভাগ করা হতো । ‘সমাজের’ সকল মানুষের মাঝে মাথাপিছু গোশ্ত ভাগ করা হতো । সেই সাথে প্রায় প্রতিটি বাড়ি হতেই খিচুড়ি সিন্নি আসতো যা সকলে মিলে ভাগ করে খেতো । অতঃপর যে যার বাড়ির পথ ধরতো ।
ঈদের দিন আমরা এ বাড়ি ও বাড়ি ছুটা ছুটি করতাম। সমবয়সীদের সাথে নানা ধরনের খেলাধুলা করতাম।এক সময় সাঁঝ নামলে বাড়ি ফিরতাম । চুলার পাশে বসে মায়ের হাতের রান্না করা গরম ভাপওয়ালা গোশ্ত মজা করে খেতাম । (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও লেখক
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
বাসা: টেবুনিয়া, পাবনা।