এবাদত আলী
বাংলাদেশে বর্তমানে বলতে গেলে ডেঙ্গু নামক রোগটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন মিডিয়ার তথ্য মতে এপর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের ৬৪ জেলায় ২১ জন রোগি মৃত্যুবরণ করেছে । সরকারি হিসেবে এর সংখ্যা ৮। এবং আক্রান্ত রোগির সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ডেঙ্গু জ্বর বা ডেঙ্গি যা ব্রেকবোন ফিভার নামে পরিচিত একটি সংক্রামক ট্রপিক্যাল ডিজিজ যা ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে হয়। ডেঙ্গু প্রজাতি এডিস দ্বারা পরিবাহিত হয়।
বিভিন্ন তথ্য -উপাত্ত হতে জানা যায় যে, ১৭৭৯ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রোগকে বলা হতো হাড়ভাঙা রোগ। এই রোগের ভাইরাস ঘটিত কারণ এবং সংক্রমণ বিষয়ে বিষদ জানা যায় বিংশ শতকের প্রথমভাগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালিন সময় থেকে ডেঙ্গু দুনিয়াজোড়া সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এবং ১শ ১০টিরও বেশি দেশে মহামারির আকারে রূপ নেয়। মশাকে বিচ্ছিন্ন করা ছাড়াও ভ্যাকসিনের ওপর কাজ চলতে থাকে এবং তার সাথে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় সরাসারি ভাইরাসের ওপর। যতদুর জানা যায় ১৯৬০ সালের পর থেকে এই রোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ৫০-১০০ মিলিয়ন লোক এতে আক্রান্ত হয়।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক পরিসংখ্যান হতে জানা যায় মশার কারণে শুধু এক বছরে নানা রোগে আক্রান্ত হয় ৭০ কোটির মত মানুষ। তাদের মধ্যে মারা যায় ১০ লাখেরও বেশি।
এবছরে নিকারাগুয়ায় তিন হাজারের ওপর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১হাজার ৭শ লোক এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে পত্র-পত্রিকা হতে জানা গেছে। গত ৮ জুলাই দৈনিক সিনসা পত্রিকা লিখেছে, বাংলাদেশে গত দুই দশকে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার কামড়ে ২৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু সরকারি হিসেবেই এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে এসময়কালে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়েছেন ৫২ হাজার ৮৪০জন। স¦াস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তারা বলেন অনেকসময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও অনেকেই হাসপালে আসেননা, অনেকেই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বার ও ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান। যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছেন তাদের পরিবার থেকে জানা গেছে তাদের অধিকাংশই সুস্থ্য ও সবল দেহের অধিকারি। হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়াসহ নানা জটিলতায় আইসিইউতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। স্বাস্থ্য অধি দফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের সহকারি পরিচালক ডা. আয়েশা আকতার জানান, ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল,ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গুতে মোট ৫২ হাজার ৮৪০ জন ভর্তি হন। সুত্রমতে গত প্রায় ২ দশকে দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দিলেও ডেঙ্গুবাহি এডিস মশা দমন করা সম্ভব হয়নি। মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (দক্ষিণ ও উত্তর) প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মশার ওষুধ ছিটালেও কাজ হচ্ছেনা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রকোপ সম্পর্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অভিজাত এলাকায়ই ডেঙ্গু মশার প্রকোপ বেশি। তারা কেউ শখ করে বাগান তৈরি করেন, কেউবা বাড়িতে কৃত্রিম ঝরণা বসান। এছাড়া ঘরের এয়ারকন্ডিশনের জমে থাকা পানি পরিষ্কার করেননা। এসব কারণে অভিজাত বাসাবাড়িতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বেশি। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে মুক্ত হতে চাইলে সরকারের চেয়ে ব্যক্তিগতও পারিবারিক জনসচেনতাই বেশি প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। (দৈনিক সিনসা-০৮-০৭-২০১৯)।
ডেঙ্গু জ্বরের মত মারাত্মক রোগের একমাত্র বাহক এডিস মশা। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু –সবাই বহন করে এই মশা। শুধু বহন করেই ক্ষান্ত হয়না, সামন্য এক কামড়ে একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে এসব ছড়িয়ে দিতে পারে অনায়াসে।
জানা যায় প্রায় ৪শ বছর আগে আফ্রিকায় ভয়ঙ্কর এই এডিস মশার জন্ম। পরবর্তীকালে এটি পৃথিবীর গ্রীষ্ম মন্ডলীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
আমাদের দেশের মশা এমনি কড়িৎকর্মা প্রাণী যে, এক চিলতে জায়গা পেলেই দৌড়ে পালাতে সক্ষম। এক নিমিষে উড়ে একশ গজ দুরে যেতে এবং ইচ্ছা করলে প্রায় তিরিশ মিটার উপরে উঠতে পারে। বসত বাড়ির আশপাশের ড্রেন, জলাশয়, ডাবের খোসা কিংবা তরিতরকারির ছোবড়ার উপর সামান্য পরিমাণ পানি জমে থাকলে স্ত্রী জাতীয় মশা ডিম পেড়ে অবাধে বংশ বিস্তার করতে পারে। শকুনের মত দেড় মাস এবং মুরগির মত একুশ দিন ধরে ডিমের উপর বসে তা দিতে হয়না। মশার ইনকিউবেটর মেশিন এতই শক্তিশালী যে, মশা ডিম পাড়ার কিছু সময় পরেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মশার বাচ্চা কিউলেক্স, এনোফিলিস কিংবা এডিস যে জাতেরই হোকনা কেন ডিমের খোলস থেকে বের হবার কিছু সময় পরেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে রাক্ষসের মত হাউ মাউ মানুষের গন্ধ পাও বলে মানুষসহ গরু-মহিষ ও অন্যান্য জন্তু জানোয়ারদের খোঁজ করতে থাকে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই মশক কুলের জ্বালাতন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ক্ষুদ্রতম প্রাণী মশার মাধ্যমে মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। মশাবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার, জাপানিজ এনসেফালাইটিস, চিকুনগনিয়া প্রভৃতি। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কিউলেক্স প্রজাতির মশা এবং কিউলেক্স কুইনকুইফেসিয়েটাস মশা ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগ সৃষ্টি কারী পরজীবী কৃমির বাহক। পৃথিবী ব্যাপি মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়।
তবে এডিস মশা আবার অন্যসব মশার চাইতে বলতে গেলে অভিজাত শ্রেণী। এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু বিষয়ক প্রোগ্রাম ম্যনেজার ডাক্তার এমএম আক্তারুজ্জামান বলেছেন,‘ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা যে সিটিতে বা এলাকায় একবার ঢোকে সে এলাকায় আর নিস্তার নেই। কেননা এডিস মশার ডিম শুকনা পরিবেশেও ৯ মাস পর্যন্ত সক্রিয় থাকে, নষ্ট হয়না। আর যখনই স্বচ্ছ পানির সংষ্পর্শে আসে তখনই তা লার্ভা হয়। পরিপুর্ণ মশার রূপ নেয়। তিনি আরো বলেন, আমরা গাড়িতে টায়ার ব্যবহার করি বিদেশ থেকে সেই টায়ারে করে যদি এডিস মশার ডিম আসে সেটা যদি পানির সংস্পর্শে আসে সেখান থেকেই এডিসের জন্ম হবে। তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালে আমরা যে পরিমাণ লার্ভা পেয়েছিলাম, এবার তার তুলনায় শতভাগ বেশি পাওয়া গেছে। মুলত নির্মাণাধীন ভবন, জমে থাকা পানি, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে আমরা লার্ভা পেয়েছি। ডা. জামান বলেন, ব্যক্তি সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন উপায় নেই।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, এডিস মশা মুলত দিনের বেলা সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে রাতের বেলা উজ্জল আলোতেও কমাড়াতে পারে। তাই এসময় শরীর ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। দিনের বেলা পায়ে মোজা ব্যবহারের পরামর্শও তারা দিয়েছেন। শিশুদের হাফ প্যান্টের বদলে ফুল প্যান্ট বা পাজামা পরাতে হবে। দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে। দরজা জানালায় নেট লাগানোর পরামর্শও রয়েছে। এয়াড়া স্প্রে, কয়েল, লোশন, ক্রিম, ম্যাট ব্যবহার করতে পারেন।ফলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, বাড়ি-ঘরের আশেপাশে যে কোন পাত্রে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি যেন ৫ দিনের বেশি না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাড়ির ছাদে, বাগানের টবে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বাড়ির আশেপাশের ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার রাখতে হবে।
এক কথায় এডিস মশা ও তার বংশ বিস্তার সম্পর্কে সকলকেই সজাগ থাকতে হবে। একমাত্র জনসচেতনতাই এমন ভয়াবহ রোগ থেকে রক্ষা পাবার উপায় বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করেন। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।