মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে দেশের সকল দুগ্ধ কোম্পানি দুধ ক্রয় ও বিপণন কার্যক্রম বন্ধ রাখার প্রতিবাদে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খামারিরা সড়কে দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করেছেন। সোমবার দুপুরে ভাঙ্গুড়া শহরের প্রবেশ মুখে অর্ধ শতাধিক খামারি দুধ ঢেলে এই প্রতিবাদ জানান। এর আগে তারা সেখানে ৩০ মিনিট ব্যাপী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এসময় শহরে প্রবেশকারী যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্থ হয়। মানববন্ধনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের দুগ্ধ সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপক ও খামারিরা বক্তব্য রাখেন।
পারভাঙ্গুড়া গ্রামের খামারি হাসিনুর রহমান বলেন, ‘আমার খামারে প্রতিদিন ৬০ লিটার করে দুধ উৎপন্ন হয়। এই দুধ আমি ব্র্যাক জগাতলা দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র বিক্রি করি। দুধ বিক্রির টাকার ওপর ভরসা করে আমি ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ৩ লাখ টাকা লোন নিয়ে গত তিন মাস আগে দুইটি গাভী কিনেছি। এখন ওই ব্যাংকে প্রতি মাসে আমাকে ৩০ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। কিন্তু এখন নির্ধারিত মূল্যে দুধ বিক্রি করতে না পারলে ব্যাংকের লোন পরিশোধ করবো কিভাবে। বাহিরে দুধ বিক্রি করতে গেলে ৬’শ থেকে ৭’শ টাকা মণ দরে দুধ বিক্রি করতে হয়। ওই টাকায় গাভী প্রতিপালন করবো, নাকি ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবো। এভাবে চলতে থাকলে গাভি বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
মানববন্ধন একই গ্রামের দুগ্ধ ব্যবস্থাপক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমরা শতভাগ খাঁটি দুধ দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রে সরবরাহ করি। দুগ্ধ কোম্পানিগুলোর চিকিৎসকরা গাভীকে যে ধরণের খাদ্য খাওয়াতে বলে, আমরা সে খাদ্যই খাওয়াই। সেখানে দুধে এন্টিবায়োটিক বা সীসা পাওয়া গেলে সেটার দায়ভার আমাদের কিভাবে থাকে। দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রের কর্মচারীরা তো আমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছে যে আমরা দুধে কোনো ভেজাল মেশাই না। সেক্ষেত্রে কোন সরকারী দপ্তর বা দুগ্ধ কোম্পানির ঢাকা অফিসে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দুধে কোন ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া গেলে সেটার দায়ভার কোম্পানি বহন করবে। কিন্তু কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে দরিদ্র খামারিদের দুধ ক্রয় বন্ধ করতে আদেশ দিলেন। এখন আগামী পাঁচ সপ্তাহ এভাবে চললে আমরা পথে বসে যাব।’
ভাঙ্গুড়া উপজেলা পাড়ার খামারি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দুই যুগ আগে আমরা দেশি গরু পালন করতাম। সে সময় যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হতো, সেটা শুধু পরিবারের চাহিদা মেটাতো। তখন বিভিন্ন দুগ্ধ কোম্পানি এলাকায় এসে আমাদেরকে উন্নত জাতের গাভী পালনে সহায়তা করে। কোম্পানিগুলোর দেয়া বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিতে এলাকার সাধারণ কৃষকরা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে গাভি কিনে প্রতিপালন শুরু করে। এতে কৃষকদের উৎপাদিত দুধের পরিমাণ আগের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এখন নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে দুধ বিভিন্ন দুগ্ধ কোম্পানিকে সরবরাহ করে বাড়তি আয় করে খামারিরা। এভাবে অনেকের পরিবার এখন সচ্ছল। কিন্তু বর্তমানে দুধের বাজারের এরকম নাজুক পরিস্থিতিতে দুগ্ধ খামারিরা চরম উদ্বিগ্নœ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।’
জানা যায়, এই উপজেলায় বড় ও মাঝারি আকারের ৭৪৫টি দুগ্ধ খামার রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের খামারের সংখ্যা আছে প্রায় ২২’শ। এসব খামার থেকে দৈনিক গড়ে প্রায় ৬৫ হাজার লিটার দুধ উৎপন্ন হয়। মিল্কভিটা, ব্র্যাক, প্রাণ, আকিজ ও বারো আউলিয়া দুগ্ধ কোম্পানির ২৮টি ক্রয় ও শীতলীকরণ কেন্দ্র উৎপাদিত এ দুধের ৮০ ভাগ দুধ ক্রয় করে। কিন্তু হাই কোর্টের নির্দেশে এই দুধ ক্রয় বন্ধ হওয়ায় মহা বিপাকে পড়েছে উপজেলার দুই সহ¯্রাধিক দুগ্ধ খামারি।
ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মেয়র ও দুগ্ধ খামারি গোলাম হাসনায়েন রাসেল বলেন, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে দুগ্ধ ক্রয়ে স্থানীয় দুগ্ধ কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে দুধ ক্রয় বন্ধ রাখে। সম্প্রতি কোম্পানিগুলো খামারিদের বিরুদ্ধে দুধে ভেজাল মেশানোর অভিযোগ করেছে। কিন্তু এ সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন। মেয়রের অভিযোগ, ভাঙ্গুড়ার দুধে কোন প্রকার ভেজাল বা রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেলে সেটা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কর্মচারীরা করে।
দুধ সংগ্রহ বন্ধের ব্যাপারে ভাঙ্গুড়া মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ ও প্রধান অফিসের সিদ্ধান্ত সোমবার সকাল থেকে দুধ ক্রয় বন্ধ আছে। এতে খামারিরা দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। এখন মহামান্য হাইকোর্ট এবং অফিসের পরবর্তী সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত এভাবেই দুধ সংগ্রহ বন্ধ থাকবে।