বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের সরকারি সফরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। মিটবে দ্বিপাক্ষিক একাধিক সমস্যার জট। উপকৃত হবেন দু’দেশের সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থেই জরুরি প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের আমন্ত্রণে দিল্লি সফর করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন।
উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই আগামী দিনে সাধারণ মানুষের স্বার্থে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা মিটিয়ে সম্পর্ককে আরও মজবুত করার কথা বলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ড. হাছান মাহমুদ প্রথম দিল্লি সফর শুরুই করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে একান্ত বৈঠকের মাধ্যমে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে দুদেশ যে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করার বিষয়ে কতোটা আগ্রহী এই বৈঠক তারই প্রমাণ। দোভালের সঙ্গে বৈঠকের পরই ড. হাছান মাহমুদ দিল্লির রাজঘাটে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর দাহস্থান ও স্মৃতিসৌধ চত্বরে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। ভারতের জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতেও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তিনি। ‘বাংলাদেশ-ভারতের বর্তমান সম্পর্ক’ বিষয়ে বৃহস্পতিবার দিল্লিতে এক মতবিনিময় সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত তার সফরে ছিল একাধিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ছাড়াও ভারতের অন্যান্য পদাধিকারীদের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। সাংবাদিকদের সামনে বারবার তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে বার্তা দেন। দুদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেন, অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে।
ভারত সফরকারে সাংবাদিকদের ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বেও ভারতের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। তার মতে, এই উন্নয়ন অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষার বিকল্প নেই। উভয় দেশের সরকার সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন ড. হাছান মাহমুদ। একান্তেও তাদের মধ্যে কথা হয়। বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে খোলামেলা ও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় উঠে আসে, সীমান্তে হত্যা নয় সৌহার্দ্য বজায় রাখা, আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ বৃদ্ধিতে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে ভারতের ব্যবহারের কার্যকর সূচনা, বিদ্যুৎ শক্তির উৎসজনিত সহায়তার বিষয়সমূহের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারসহ তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন এবং মিয়ানমারে চলমান পরিস্থিতি নিয়েও একযোগে কাজ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক শেষে ড. হাছান মা৩হমুদ আরও জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দু’দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক যে নতুন উচ্চতায় উঠেছে, সেটিকে আরও ঘনিষ্ঠ ও গভীর করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারসহ তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে পুণর্বাসন এবং মিয়ানমারে চলমান পরিস্থিতি নিয়েও একযোগে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ড. হাছান ভারতের ইতিবাচক মানসিকতার ব্যাপক প্রশংসা করেন। তার মতে, উভয় দেশের সম্পর্ক এখন অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। ইতিমধ্যেই উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একগুচ্ছ যৌথ প্রকল্পের উদ্বোধনও করেছেন। আরও বহু প্রকল্পের কাজ চলছে। পানিসম্পদ নিয়েও ভারতের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। তিস্তার পানি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিস্তা সমস্যার দ্রুত সমাধানের বিষয়েও আশাবাদী তিনি। ২০২৬ সালে গঙ্গার পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাই অবিলম্বে সেই চুক্তি রূপায়ণের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা জরুরি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড এখনও বন্ধ হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টিতে আলোকপাত করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার মতে, উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন জরুরি। সীমান্তে গুলি চালনার ঘটনা শূণ্য নামিয়ে আনতে হবে। এবিষয়ে ভারতের তরফ থেকেও সীমান্তে শান্তি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন তিনি। সামনেই রোজার মাস আসছে। ভারত থেকে রপ্তানি যাতে কোনও অবস্থাতেই বিঘ্নিত না হয় সেবিষয়টিও নজর দেওয়ার জন্য তিনি দিল্লিকে অনুরোধ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সঙ্গেও তার ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধা নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়। ভারত বিষয়টির দ্রুত সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সেদেশের নাগরিকদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নও প্রশংসিত হয়েছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ফের উভয় দেশ একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও উভয় দেশ একসঙ্গে কাজ করবে। ড. হাছান মাহমুদ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে ঢাকায় জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন বা জেসিসি-র বৈঠকে যোগ জয়শঙ্করকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ড. হাছান মাহমুদ। তার আমন্ত্রন গ্রহণ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার এই ভারত সফরে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমানসহ পররাষ্ট্রমন্ত্রকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গয়ালের সঙ্গেও বৈঠক করেন ড. হাছান মাহমুদ। সেই বৈঠকে উঠে আসে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা। ট্রেড ব্যালান্স নিয়েও তাঁদের মধ্যে কথা হয়। ঢাকায় ফেরার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতাও সফর করেন। সেখানে এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীণ প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতোবিনিময় করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বারবার উঠে আসে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা। জাতিরপিতার আদর্শেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, বৈরিতা নয় কারও সঙ্গে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথাও বারবার উঠে আসে তার কথায়। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের অবদানের কথাও বলেন তিনি। সবমিলিয়ে ড. হাছান মাহমুদের বৈঠকে ব্যাপক সফল। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন মাইলস্টোন রচিত হতে পারে তার এই সফরের হাত ধরে। ভারতের তরফে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার আন্তরিক সমাধানের পাশাপাশি ভিসা পদ্ধতি আরও সহজ করার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। বিনিয়োগও বাড়তে পারে তার এই সফরের হাত ধরে। ভারত বলেছে, অতীতের মতোই প্রকৃত বন্ধু হিসাবে বাংলাদেশের পাশে থাকবে সবসময়।