// ইয়ানূর রহমান : বেনাপোলের বাহাদুরপুর পল্লীতে প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলনের মহোৎসব। সরকারি দপ্তরের সংশ্লিষ্ঠ আইন প্রয়োগকারি কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ বিহীন কয়েক বছর যাবত এ এলাকা থেকে একাধারে প্রতিদিন একাধীক ড্রেজার মেশিনে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। ফলে, পাশের আবাদী জমিগুলো ভারসাম্য হারিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ভূগর্ভে। এসাথে, বিভিন্ন স্থানে বিক্রয়কৃত বালিবাহী শতাধীক ট্রাক, ট্রাক্টর ও পাওয়ার ট্রিলারে তৈরি বালিবাহী যান ‘প্রতিদিন গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলাচল করায়’ ধূলো উড়ে পরিবেশ নষ্ট করছে। স্থাস্থ্যহানিসহ নানা বিড়ম্বনা উপলব্ধি করছে রাস্তার দু’পাশের বসতীরা। একইসাথে ব্যস্ততম বেনাপোল-বাহাদুর সড়ক দিয়ে চলাচলকারি এসকল যানবাহনের চালকরা বেশি আয়ের জন্য একাধিকবার বালি বহনের নেশায় বে-পরোয়া হয়ে চলাচল করায় মারাত্বক বিপাকে পড়তে হচ্ছে স্কুলগামী কোমলমতি ছোট ছোট শিশু-কিশোরসহ পথচারিদের।
কোন বাধা বিপত্তির তোয়াক্কা না করে মনিরের আশ্চর্যজনক এ আলাদিনের চেরাগে বস্তির বাসিন্দা থেকে পাড়ার শীর্ষ ধনী এবং বিএনপির নেতার তালিকায় নাম উঠে আসায় হতবাক হয়েছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয়দের দাবি, স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বারবার এ অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে মনিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও অজ্ঞাত কারণে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন ও বিক্রয়। বরং, মনিরের লাঠিয়াল বাহিনীরা দম্ভক্তি দিয়ে বলে, প্রশাসনকে রিতিমত মোটা অংকের টাকা দিয়ে বালির ব্যবসা করতে হচ্ছে।
সরেজমিনে যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল পোর্ট থানার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের শাখারিপোতা বাজারে কথা হয় জনৈক ব্যক্তির সাথে। তিনি জানান, শার্শা উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা কার্যালয়ের উর্দ্ধতন এক কর্মকর্তাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এবং বেনাপোল ভূমি সহকারি অফিসের কর্মকর্তা (নায়েব) কামাল হোসেনের মাধ্যমে প্রশাসনের কয়েকটি দপ্তরে সাপ্তাহিক এক লক্ষ টাকা চুক্তিতে এ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে বিএনপি নেতা মনির হোসেন।
সে দীর্ঘদিন যাবত এলাকার জমির মালিকদের ফুঁসলিয়ে পুকুর কেটে দেওয়ার নামে ড্রেজার ও স্কোভেটরের মাধ্যমে তুলে নিয়ে যাচ্ছে সরকারের মহামূল্যমান খনিজ সম্পদ বালি। প্রতিনিয়ত যদি লাগামহীনভাবে এভাবে ফসলি জমি থেকে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন করতে থাকে তাহলে একসময় পাশর্^বতী অন্যন্য ফসলি জমিগুলোও ভূ-গর্ভে চলে গিয়ে পতিত জমিতে পরিণত হবে। সেখানে না হবে মাছ, না হবে ফসল। বালি বিক্রির কালো টাকার ছড়াছড়ি আর অবৈধ ক্ষমতার দাপটে তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী টু-শব্দ করতে পারে না বলে জানান তিনি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই বিষয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে একাধীকবার জানানো হলেও এপর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এসাথে অবৈধ বালি উত্তোলনের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় বহুবার বালি স¤্রাট মনিরের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশিত হলেও বহাল তবিয়্যতে চলছে তার বালি উত্তোলন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাহাদুরপুর বাওড়-খালের শেষের প্রান্তে সোনামুখো বিলের সাথে বিএনপি নেতা নিপুনের মালিকানা মাছের ঘেরে অসংখ্য ড্রেজার মেশিন বসিয়ে লক্ষ লক্ষ ফুট বালি উত্তোলন, নামমাত্র পুকুর ভরাটে মজুদ ও সেখান থেকে বিক্রয়কৃত শতাধীক ট্রাক, ট্রাক্টর ও পাওয়ার ট্রিলারে তৈরি বালিবাহী যানবাহন গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। যার দেখভাল করছেন কণ্যাদহ গ্রামের বাসিন্দা জামায়াত নেতা মোক্তার হোসেন ও তার ভাই সহিদুল ইসলাম।
এসাথে জানা যায়, পার্শ্ববর্তী মাছের ঘের থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন লক্ষণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারা পরিবারের সদস্য প্রবাল।
মুঠোফোনে কথা হয় বালুমহালের স¤্রাট খ্যাত মনির হোসেনের সাথে। তিনি বাহাদুরপুরসহ বেনাপোলের বিভিন্ন এলাকা থেকে বালি উত্তোলন ও ব্যবসার বিষয়ে সত্যতা প্রকাশ করেছে। সেসাথে সাংবাদিকদের প্রতি ধিক্কার দিয়ে বলেছেন আমি বিএনপি করি বলে সাংবাদিকরা আমার পিছনে লাগতে পারে! আপনারা কেবল আমার নিয়ে লিখতে পারেন! আমার পাশেও অনেকে বালি তোলে তা-তো আপনাদের চোখে পড়েনা।
কথা হয়, বেনাপোল সহকারি ভূমি অফিসের কর্মকর্তা (নায়েব) কামাল হোসেনের সাথে। তাকে ১ লক্ষ টাকা চুক্তিতে বালি স¤্রাট মনিরের সাথে দফারফার কথা জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা ভূমি সহকারি কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে জানাবেন বলে জানান।
পরক্ষণে মুঠোফোনে কথা হয়, শার্শা উপজেলা সহকারি কর্মকর্তা (ভূমি) ফারজানা ইসলামের সাথে। তিনি দীর্ঘ আলাপচারিতায় বলেন, মনিরকে তিনি চেনেন না এবং তার সাথে প্রশাসনের কোন অবৈধ চুক্তি নেই। এছাড়া বালি মহালে বারবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলেও কোথাও মহাজন পাওয়া যায়না, নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়। যে কারণে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা হলে শার্শা উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা শ্রী নারায়ন চন্দ্র পাল উপস্থিত সহকারি কর্মকর্তা (ভূমি) ফারজানা ইসলামের সাথে অবৈধ বালু উত্তোলনকারি মনিরের মজুদকৃত বালি নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ করেন। একথার ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও সেখানে অদ্যবধি বালি স¤্রাট মনিরের অবৈধ বালি উত্তোলন ও বিক্রয় প্রক্রিয়া চলমান থাকায় বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।
সরকারের ২০১০ সালের বালুমহল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উম্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ।