ফেলে আসা দিন গুলো -৫০


— এবাদত আলী —
১৯৭৮ সালের ৭ মে তারিখে পাবনার আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠন করা হয়। এর পরপরই অর্থাৎ ১৭ মে-১৯৭৮ তারিখে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান আটঘরিয়া কলেজে আগমণ করবেন এবং কলেজ মাঠে জনসভায় ভাষণ দিবেন বলে জানা যায়। আটঘরিয়ার রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দের পরামর্শ মোতাবেক আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের পক্ষ হতে প্রেসক্লাবের সভাপতি উক্ত জনসভায় বক্তব্য রেখে রাষ্ট্রপতিকে আটঘরিয়া বাসীর অভাব অভিযোগ নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি আটঘরিয়া প্রেসক্লাব সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের আগমণে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের পক্ষ হতে একটি ব্যানার লেখা হলো। ব্যানারটি লিখে দেন প্রেসক্লাব সদস্য আর্টিষ্ট আব্দুল কুদ্দুস সাগর।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ পাবো ভাবতে বেশ ভালোই লাগছিলো। তাছাড়া আরেকটি অভিপ্রায় ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধের সুচনালগ্নে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ যিনি চট্রগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন, এবং তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন বিধায় এই বিরোচিত ব্যক্তিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে একটি মানপত্র প্রদানেরও সিদ্ধান্ত হয়।
এ ব্যাপারে আটঘরিয়া প্রেসক্লাবে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে যাবার সময় প্রত্যেক সাংবাদিকের জন্য আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের ব্যাজ এবং একটি ব্যানার থাকবে। জনসভায় সাংবাদিকদের বসার জন্য পৃথক জায়গার ব্যবস্থা কথা মিটিংিএ জানানো হয়। সভায় মানপত্র প্রদানের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। যেহেতু নব গঠিত প্রেসক্লাব তাই এব্যাপারে কেউ কোন দ্বিমত পোষন করলেন না। সভায় আমিরুল ইসলাম রাঙার ওপর এই মানপত্রটি লেখা এবং বাঁধানোর ভার দেওয়া হলো।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্যে মানপত্রটি লিখেছিলো আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের অন্যতম সদস্য আমিরুল ইসলাম রাঙা। মানপত্রটি ছিলো নিম্নরূপ: – ‘‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের আটঘরিয়ায় আগমণে জয়ন্তিক শুভেচ্ছা।
হে বিষুবিয়াষ, জাতির সম্ভ্রম, ভয়, আকুতি, নিষ্পন্ধতা এবং সকল প্রকার অনগ্রসরতার অভিশপ্ত বাধার প্রাচীর তুমিই ভেঙ্ েছিলে। উত্তপ্ত লাভার গভীর জরায়ূর ভেতর থেকে তোমার ভূমিষ্ঠতা- সমগ্র বাংলাদেশীর আর্শিবাদ।
হে চেতনা, রণক্ষেত্রের উদ্দীপ্ত সৈনিক দেশ গড়ার মহান প্রত্যয়ে যে মহানুভবের পরিচয়ে আলোকিত সত্যিই ইতিহাসের পাতায় এ এক নতুন সংযোজন।
হে যুগান্তর, যুগের অসহ্য ব্যাথা তোমাকে কাঁদিয়েছিলো- বুঝেছিলে সময়ের ঘন্টির মত কর্তব্যভার নিতে হবে তোমাকেই। আজ কর্তব্য-দায়িত্ব এবং স্বদেশ প্রেমিকতার সমস্ত সফলতা -তোমার কর্মের মধ্যেই নিহিত।
হে ফলভারন্ত, তোমার আকাংখিত স্বপ্নের স্লোগান গুলি আজ বাংরার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে
ঝংকার তুলেছে। ঘুমন্ত আদিমের নীরব আর্শিবাদে তোমার জয় অবসম্ভাবী। মহান সৃষ্টির চির উল্লাস বিস্ফোরিত হবেই।
হে আদর্শ, চাওয়া পাওয়ার মাপকাঠিতে নয়, ভালোবাসায় অনুপ্রাণিত কিছু কলম সৈনিক দেশ গড়ার যুদ্ধে তোমার মত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে অংশ নিতে চায়। অনিসন্ধিৎসুমনপ্রার্থীদের অঙ্গিকার তুমি শুধু আর্শিবাদ কর। তারিখ- ১৭/০৫/১৯৭৮ সাল-
কামনান্তে—
আব্দুস ছাত্তার মোল্লা প্রধান উপদেষ্টা।। এবাদত আলী সভাপতি।। আব্দুস সাত্তার মিয়া সাধারণ সম্পাদক এবং আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সদস্যবৃন্দ, আটঘরিয়া, প্রেসক্লাব, পাবনা।’’
নির্ধারিত তারিখে আটঘরিয়া হাইস্কুল মাঠে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আগমণ করলেন, জনসভা হলো, তিনি আটঘরিয়া কলেজকে কৃষি কলেজ হিসেবে ঘোষণা দিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতার ভিড়ে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে সভাপতিকে বক্তব্য রাখার কোন সুযোগ দেয়া হলোনা। অগত্যা কোন মতে রাষ্ট্রপতির হাতে মানপত্রটি তুলে দেয়া হলো। পরে অবশ্য এর জন্য স্থানীয় নের্তৃবৃন্দ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তবে সামান্য সময়ের জন্য হলেও স্থানীয় সাংবাদিগবৃন্দ তাঁর সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। এটাই ছিলো সেদিনের বড় স্বান্তনা।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আটঘরিয়া মহাবিদ্যালয়কে কৃষি কলেজ হিসেবে ঘোষণা দিবার পর থেকেই আটঘরিয়ার সাংবাদিকগণ তা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করে। কখনো বা নিউজ আবার কখনো বা ফিচার লেখা চলতেই থাকে। রাষ্ট্রপতির ঘোষণার কয়েকমাস পর অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে আটঘরিয়া কৃষি কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হলো। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার এম শফিউল আলম। প্রস্তাবিত আটঘরিয়া কৃষি কলেজের অধ্যক্ষ মফিজ উদ্দিন আহমেদ আটঘরিয়া প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদেরকে দাওয়াত দিলেন উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য। আমরা সকল সাংবাদিক মিলে এদিনের অনুষ্ঠানে যোগদান করলাম। পাবনা জেলা প্রশাসক এম এ জব্বারসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা এলেন অনুষ্ঠানে। বিভাগীয় কমিশনার শফিউল আলমকে কলেজের পক্ষ থেকে ‘মানপত্র’ প্রদান করা হলো। তাতে লেখা হলো আজ আটঘরিয়া কৃষি মহাবিদ্যালয়ের এক অবিস্মরণীয় দিন। আপনার মত উদার-উন্মুক্ত একনিষ্ঠ কর্মী, গুণী, জ্ঞাণী, বিদ্যোৎসাহী ও মহানুভব ব্যক্তিকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা আজ ধন্য। শীতার্ত এই বিকেলে অনেক কায়ক্লেশের মধ্য দিয়ে আপনি যে আদর্শকে লক্ষ্য করে এখানে শুভাগমণ করেছেন সেজন্য আমরা গর্বিত ও কৃতজ্ঞ। কৃষি প্রধান দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা ও উন্নয়ন কৃষির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও একমাত্র ঢাকা ও মোমেনশাহী ছাড়া উচ্চতর কৃষি শিক্ষার আর কোথাও ব্যবস্থা নেই। বিশেষত:সমগ্র উত্তরাঞ্চল এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপেক্ষিত। এই সমস্যার সমাধান কল্পে আমরা আটঘরিয়া মহাবিদ্যালয় স্থাপন করে প্রাথমিকভাবে উচ্চমাধ্যমিক কৃষি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করি। আর একে উন্নীত করে আটঘরিয়া বিএজি মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য আনুসঙ্গিক উপকরণ সহয়োগে আপনার সাহায্য ও সহানুভুতির ছত্রছায়ায় সদাশয় বাংলাদেশে সরকারের কাছে আবেদন জানালে সরকারের পক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (বিরোত্তম) আটঘরিয়া বিএজি মহাবিদ্যালয়ের ঘেষণা দেন। যার প্রেক্ষিতে বিলম্বে হলেও মহান করুনাময় আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় অদ্য আপনার হাতেই তার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হলো। এজন্য আপনি পাবনা তথা উত্তরবঙ্গের জনগণের চিন্তার প্রয়াসে ও এই বিএজি মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
জেলা প্রশাসক এম এ জব্বারকেও আরেকটি মানপত্র প্রদান করা হলো।
যাক, আটঘরিয়া প্রেসক্লাব গঠনের কিছুদিন পরই বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির আটঘরিয়া শাখা গঠন করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে আমাকে সভাপতি এবং আমিরুল ইসলাম রাঙাকে সম্পাদক এবং আব্দুস সাত্তার মিয়া, এইচকেএম আবু বকর সিদ্দিক, মোহাম্মদ ইয়াছিন, এস দাহার মাতলু, হাসান আলী, মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী আব্দুস সাত্তার ও আব্দুল কুদ্দুস সাগরকে সদস্য করা হলো। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির পাবনা জেলা শাখার নেতৃবৃন্দ আটঘরিয়া প্রেসক্লাবে আগমণ করবেন বলে জানানো হলে আমরা তাদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাই। সে মোতাবেক পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির পাবনা জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট রনেশ মৈত্র, পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আনোয়রুল হক, সাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবি, হাসনাতুজ্জামান হিরা, আ জ ম আব্দুল আউয়াল, আবদুল মতীন খান প্রমুখ সাংবাদিকগণ আটঘরিয়া প্রেসক্লাবে আগমণ করেন। তাঁরা বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বি-বার্ষিক সন্মেলনে ঢাকা যাবার জন্য আমাদেরকে বলেন। আমরা সকলেই তাতে রাজি হই। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
 সাংবাদিক ও কলামিস্ট