ফেলে আসা দিন গুলো-৪২

// এবাদত আলী//
এদিকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দলটি পাবনার চাটমোহর থানার ফৈলজানা গ্রামের নাথু পাটনীর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা পূর্ব দিকে নৌকাটি রেখে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পায়ে হেঁটে বাড়িটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। বাড়ির দক্ষিন সংলগ্ন নদীতে ডিঙি নৌকা নিয়ে অবস্থান করছিল আরেকটি দল। রাত ঠিক দশটায় কমান্ডারের সংকেত পাবার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে গুলি ছঁড়–তে আরম্ভ করে। গুলির শব্দ শুনে আশে পাশের লোকজন ভেবেছিল হয়তো বা এলাকায় ডাকাত পড়েছে। তাই তারা লাঠি-ফালা ইত্যাদি নিয়ে শোরগোল করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে। তখন সহ:কমান্ডার জয়নাল তার হাতে থাকা টিনের চোঙা বা টিন দ্বারা তৈরি চোঙ মুখে লাগিয়ে আগত লোগদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কথা জানাতে থাকে। এতে এলাকার লোকজন খুশি মনে দুরে সরে যায়। এ দিকে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষনের ফলে নাথু পাটনীসহ ভোজ সভায় যোগদানকারী দালাল ও রাজাকারগণ দিশেহারা হয়ে পড়ে। আত্মরক্ষার জন্য তারাও গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। কিন্তু তাদের তেমন কোন প্রশিক্ষণ না থাকায় হাতের থ্রি নট থ্রি রাইফেল ফেলে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করে। তারা যে দিকে দৌড় দেয় সে দিক থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের অস্ত্র গর্জে ওঠে। বেশ কয়েকজন সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। নাথু পাটনীসহ বাড়ির লোকজন এবং ভোজসভায় আগত দালাল ও রাজাকারগণ প্রান রক্ষার জন্য পাশের নদীতে ঝাঁপ দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িটি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়্ এবং প্রচুর গোলা বারুদ ও কয়েকটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল উদ্ধার করে। তারা দুজন রাজাকারকেও ধরে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাবার পর এলাকার জনসাধারণ মানুষ মনের ঝাল মিটাতে গিয়ে নাথু পাটনীর বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আমাদের এই মুক্তিযোদ্ধার দলটি সে রাতে উজানে দাঁড় বেয়ে প্রায় মধ্য রাতের দিকে আটঘরিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আটঘরিয়ার লক্ষনপুর গ্রামের মাস্টার আব্দুল লতিফের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। মাস্টারকে ঘুম থেকে ডেকে উঠানো হলো। লতিফ মাস্টার একটি গেঞ্জি গায়ে বেরিয়ে এলেন। চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে তাদের বাড়ি। জানাজানি হলে সমুহ বিপদ। দেখতে দেখতে তার পিতা আছির উদ্দি এলেন। এলেন ছোট ভাই আলতাব হোসেন। লতিফ মাস্টারের পিতা আওয়ামী লীগের একজন বলিষ্ঠ নেতা। লতিফ মাস্টার পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে এমএ পাশ করে সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছেন। তিনি কলেজে লেখা পড়া করার সময় ছাত্র লীগের একজন সক্রিয় কর্মি ছিলেন। আমিও ছিলাম বাংলায় অনার্সের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের প্যানেলের বার্ষিকী সম্পাদক।
এছাড়াও আমাদের সহযোদ্ধা রফিকের বাড়িও এই গ্রামে। সে সুবাদে তারা আমাদের নিকট ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। আমরা কিছু সময় অপেক্ষা করার পরই আমাদের জন্য গরম ভাত এলো। বাড়ির উঠানে খেজুরের পাটি (মাদুর) বিছিয়ে আমাদেরকে খেতে দেওয়া হলো। ভাতের সাথে আলু ভাজি আর মাশকলাইয়ের ডাউল। কুপি বাতির আলোতে বসে সকলে পেট পুরে খেলাম। খাবারের পরপরই অনেকে ঐ পাটির উপর শুয়ে পড়লো। আমরা সকলে কম কথা বলে বেশিরভাগ সমই ইশারার মাধ্যমে খওয়া-দাওয়া করছিলাম। তারপরেও এতগুলো মানুষের আনাগোনায় দুএকজন প্রতিবেশি এসে হাজির হয়। লতিফ মাস্টার আমাদেরকে পাশের গ্রাম চাটমোহরের দিলালপুরের টালক প্রামানিকের বাড়িতে নিয়ে যান। টালক প্রামানিক, তার ছেলে শাহজাহান আলী এবং গ্রামের লোকজন মুক্তিবাহিনীকে বরণ করে নেয়ার জন্য যেন আগে থেকেই তৈরি ছিলেন। আমাদেরকে দেখে তারা বেজায় খুশি বলে মনে হলো। নদীর কোল ঘেঁষে টালক প্রামানিকের বাড়ি। তাই নদীতে আমাদের নৌকা ডুবিয়ে রাখা হলো। টালক প্রামানিকের একটি বড় ঘর মুক্তিবাহিনীর জন্য খালি করা হয়েছে। মেঝেতে খড় বিছিয়ে তার উপর খেজুরের পাটি বিছিয়ে শোবার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিলালপুর গ্রামের টালক প্রামানিক এবং আব্দুস সোবহান (মুক্তিযোদ্ধা), চাঁদ আলী, আব্দুল কুদ্দুছ, মোসলেম উদ্দিন, আব্দুস সাত্তার এবং আবুল কাশেম ডাক্তারের ছেলে শহীদুল্লা মাস্টার সার্বক্ষণিক আমদের দেখাশোনা করতে ব্যস্ত থাকতেন। তারা রাত জেগে গ্রামে পাহারা দিতেন যাতে কোন শত্রু আমাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে। দিলালপুরে অবস্থানকালে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট পাস্তিানের স্বাধীনতা দিবসে আমরা একটি অপরেশনে যাই। অপারেশনের স্থান হলো চাটমোহর থানার দাঁতিয়া বামনগ্রাম অর্থাৎ ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের দাঁতিয়া কয়রাপাড়া রেল লাইনের ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া। এই অপারেশনটি ছিলো দিনের বেলা। পাবনা ঈশ্বরদী রেল লাইনের এই অংশের ব্রিজ ভেঙ্গে দিলে ট্রেনে চলাচল রত আর্মিরা আর চলাচল করতে পারবেনা এই ছিলো তার উদ্দেশ্য। আগে থেকেই দুপাশের স্টেশন মাস্টারের কাছে মুক্তিবাহিনীর তরফ হতে খবর ছিলো পাবনার ঈশ্বরদী -সিরাজগঞ্জ লাইনে দুপুরের পর থেকে যেন কোন যাত্রিবাহি ট্রেন ছাড়া না হয়। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মিদের ট্রেন এসে পড়লে তাদেরকে যেন থামানো না হয়। কমান্ডার ওয়াছেফের নেতৃত্বে টুআইসি জয়নাল আবেদীন, আব্দুর রশিদ, আব্দুল হামিদ, রফিকুল ইসলাম রফিক, মোঃ এবাদত আলী, আব্দুল মালেক, দিলালপুরের সোবহান , রশিদ, আব্দুল কুদ্দুস, ভাদু, লক্ষণপুরের লতিফ মাস্টার ও মিনহাজ উদ্দিন প্রমুখ এই অপারেশনে অংশ নেন। রেলওয়ে ব্রিজের পাটাতনের নিচে টিএনটি মাইন সেট করে ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হয়। এলাকার লোকজন এতে খুব খুশি হয়। তারা আড়ালে আবডালে থেকে দুর থেকে পাকিস্তানি আর্মিদের দশা কি হয় তা দেখার জন্য প্রহর গুনতে থাকে। এদিন বিকালে একটি ট্রেন উক্ত ব্রিজের উপর উঠামাত্র তা দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতে বেশ কিছু পাকিস্তানি আর্মি হতাহত হয় এবং তাদের প্রচুর গোলা বারুদ ব্রিজের নিচের পানিতে হারিয়ে যায়।
(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।