তিন লাখ টাকা সুদ দিতে না পারায় সংখ্যালঘু যুবকের তিন কোটি টাকার জায়গা লিখে নিল সুদারু শিক্ষক

// সোহেল রানা সিরাজগঞ্জঃ
সমাজে নীল বিষের মতো ছড়িয়ে পড়েছে অবৈধ ব্যক্তিগত সুদের ব্যবসা। ব্যক্তি সুদের কবলে পড়ে অনেক পরিবারকে নিঃস্ব হতে হচ্ছে। সামান্য টাকা সুদের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার মামলার ঘানি টানতে হচেছ অনেককে আবারো অনেকে ফেরারী জীবনযাপন করছে। এবার মাত্র তিন লক্ষ টাকা সুদের জন্য সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার ঘুড়কা ইউনিয়নের মোড়দিয়া গ্রামের সংখ্যালঘু মানসিক বিকারগ্রস্ত যুবক উজ্জল কুমার সরকারকে ভয়ভীতি-হত্যা এবং বোনকে রেপ করে এসিড নিক্ষেপের হুমকি দিয়ে ৩ কোটি টাকা মুল্যের ৬ বিঘা ১৩.৫ শতক জমি লিখে নিয়েছে পাশ্ববর্তী চান্দাইকোনা ইউনিয়নের মোজাফফরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে চিহ্নিত সুদ ব্যবসায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক ফেরদৌস আলম ও তার স্বজনরা। ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি লিখে নেয়ার ছয়মাস পর সম্প্রতি ওই সুদ ব্যবসায়ী জমি দখল নিতে আসলে বিষয়টি জানাজানি হবার পর থেকে সংখ্যালঘু পরিবারটি মধ্যে আতঙ্কেও মধ্যে দিন পারছে। প্রতিনিয়ত জমি দখল নেয়ার জন্য সংখ্যালঘু পরিবারটি হত্যা ও ঘুমের ভয়ভীতিসহ ভারতে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি প্রদান করছে। এ অবস্থায় ভুক্তভোগী পরিবারটি সুদ ব্যবসায়ীর হাত থেকে জমি ফেরতসহ পরিবারের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।

ভুক্তভোগী উজ্জল কুমার সরকার জানান, নিজের টাকার প্রয়োজন হওয়ায় সলঙ্গা থানার হাটইচলা গ্রামের আবু তাহেরের মাধ্যমে সুদ ব্যবসায়ী ফেরদৌসের কাছ থেকে তিনবারে তিন লক্ষ টাকা সুদে নেয়া হয়। তিনবার টাকার গ্রহনের সময় ছয়টি ফাকা চেক ও ৬টি সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন সুদ ব্যবসায়ী ফেরদৌস। কিছুদিন সুদ দিলেও পরবর্তীতে আর দিতে পারি না। পরে সুদ ব্যবসায়ী ফেরদৌস আলম বিষয়টি আমার ভাইদেরকে জানালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নিয়ে ডাকা শালিসী বৈঠকে সুদ ব্যবসায়ী সুদ আসলসহ মোট ৭লক্ষ টাকা হয়েছে বলে দাবী করে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে আমার ভাইগন দুই লক্ষ টাকা সুদারু ফেরসৌসকে আলমকে দিয়ে দেন। এরই মধ্যে একদিন আমি ভুইয়াগাতী বাজারে গেলে সুদ ব্যবসায়ী ফেরদৌস, আবু তাহের ও ফিরোজ উদ্দিন সুবজসহ ৬ ব্যক্তি আমাকে জোরপুর্বক মোটরসাইকেলযোগে সলঙ্গা রেজিষ্ট্রি অফিসের কাছে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখে। তারপর তারা রেজিষ্ট্রি অফিসে কাগজপত্র ঠিকাঠাক করে এনে বলে সাব-রেজিষ্টারের সামনে গিয়ে বলবে আমি টাকা পেয়েছি আমার জমি লিখে দিতে আপত্তি নেই বলে স্বীকারোক্তি দিতে হবে। না দিলে তোকে হত্যা করে লাশ ঘুম করে ফেলবো এবং তোর বোনকে রেপ করে এসিডে ঝলসে দিবো আর এই কথা কাউকে বলতে পারবি না। আমি আমার প্রাণের ভয় ও বোনের ইজ্জতের কথা ভেবে তাদের কথা মেনে নিয়ে জমি লিখে দেই এবং ভয়ে কাউকে জানায়নি। এভাবে দুবার আমাকে আটকে ভুইয়াগাতী বাজার থেকে সাড়ে চারশতক এবং মাঠে ধানীক্ষেত থেকে ৬ বিঘা ৯ শতক জমি লিখে নিয়েছে সুদ ব্যবসায়ী ফেরদৌস ও সবুজ।

উজ্জলের ভাই উৎপল কুমার সরকার জানান, আমার ভাই উজ্জল সুদে ৩ লাখ টাকা নিয়েছিল আমরা জানিনা। যখন জানতে পারি তখন এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় লোকজন নিয়ে শালিসী বৈঠক করা হয়। ওই বৈঠকে ৭ লক্ষ টাকা দাবী করা হয়। আমরা সংখ্যালঘু তাই তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিই এবং ২ লক্ষ টাকা নগদ প্রদান করি আর ৫ লক্ষ টাকার জন্য ৬ মাসের সময় নেয়া হয়। ৬মাস পর সুদ ব্যবসায়ী ফেরদৌসকে টাকা ফেরত দিতে গেলে সে বলে টাকা লাগবে না। আমরা তোমার ভাইয়ের কাছ থেকে ৬বিঘা ১৩.৫ শতক জমি লিখে নিয়েছি। এ কথা শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। সামান্য ৩ লক্ষ টাকার সুদের জন্য আমাদের ৩ কোটি টাকা মুল্যের ৬ বিঘা ১৩.৫ শতক জমি লিখে নিয়েছে। পরে ভাই উজ্জলকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায় তার গলায় ছুরি ধরেছিল এবং বোনকে রেপ করে এসিড মারার হুমকি দিয়েছিল বলে আমি লিখে দিয়েছি। আর আমাকে বলতে নিষেধ করেছিল সে জন্য ভয়ে কাউকে জানানো হয়নি। তিনি আরো জানান, জমি দখল নিতে আসলে বাধা দেয়ায় আমাদেরকে পরিবারকে হুমকির মধ্যে রেখেছে। এমনকি জমি দখল নিতে না দিলে আমাদেরকে ভারতে তাড়িয়ে দেয়া হবে বলেও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোকজনের মাধ্যমে হুমকি প্রদান করা হচ্ছে।

উজ্জলের চাচা রামতন সরকার ও ছোট ভাই সুজল কুমার সরকার জানান, আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এমনিতেই সবসময় ভয়ে থাকি। তার মধ্যে ভাইকে হুমকি-ভয়ভীতি দেখিয়ে দিয়ে জমি লিখে নিয়েছি। এখন বিভিন্নভাবে জমি দখলের জন্য হুমকি-হত্যা ও ঘুম করার ভয় দেখাচ্ছে। আমরা ন্যায় বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছি।

এ বিষয়ে শালিস বৈঠকের বিচারক ঘুড়কা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বিএ জানান, বৈঠক করে সুদ আসলে সাতলক্ষ টাকা নির্ধারন করা হয়েছিল। দুই লক্ষ টাকা দিয়েছিল পরবর্তীতে ধানকেটে বাকী ৫ লক্ষ টাকা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে সুদ ব্যবসায়ী ফেরদৌস, সবুজ ও আবু তাহের সংখ্যালঘু উজ্জলকে ভয়ভীতি-হুমকি দেখিয়ে জমি লিখে নিয়েছি। বিষয়টি জানার পর সুদারু ফেরদৌসের সাথে কথা বলেছিলাম সে বলেছে, ভাই আমি কৌশল করে জমি লিখে নিয়েছি। এখন আপনারা কিছু বইলেন না। প্রয়োজনে আমি আপনাদের ৫/৭ লক্ষ টাকা দিবোনি চুপ থাকেন। একজন সংখ্যালঘুর কাছ থেকে এভাবে জমি লিখে নেয়া সম্পুর্ন বেআইনী-অবৈধ। আমরা সরকার ও প্রশাসনের কাছে এ সংখ্যালঘু পরিবারের জন্য সুবিচার কামনা করি।

রায়গঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ইমরুল হোসেন তালুকদার ইমন জানান, ফেরদৌস আলমের পরিবার প্রায়ই এধরনের অবৈধ কাজ করে থাকে। তার বাপ-দাদাও একজন আদিবাসীর কাছ থেকে আধাবিঘা জমির কথা বলে আট বিঘা জমি লিখে নিয়েছিল। আর উজ্জলের সুদে টাকা নেয়ার বিষয়ে বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফেরদৌস ২লক্ষ টাকা নিয়েছিল এবং বাকী টাকা ধান কাটার পরে দেয়া হবে। কিন্তু এরই মধ্যে ফেরদৌস বৈঠকের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সুদের সামান্য কয়েকটি টাকার জন্য তিন কোটি টাকার মুল্যের জমি লিখে নিয়েছে। এটা সম্পুর্ন বেআইনী। সরকার যেখানে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে সেখানে একজন অবৈধ সুদ ব্যবসায়ী এধরনের কর্মকান্ড সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছে। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সরকার ও প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানাচ্ছি।

ঘুড়কা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান সরকার ঘটনাটিকে ন্যাক্কারজনক উল্লেখ জানান, উজ্জলের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। ফেরদৌসকে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ফেরদৌস আলম নোটিশ গ্রহন করেনি। পরবর্তীতে আরেকটি নোটিশ দেয়া হবে। যদি নোটিশ পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদে না আসে তবে রেজুলেশন করে উজ্জলদের দেয়া হবে যাতে তারা আদালতে আশ্রয় নিয়ে ন্যায় বিচার পেতে পারে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জানি তা হলো ছেলেকে ভয়ভীতি ও ফাঁকি দিয়ে জমিগুলো লিখে নেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে সুদ ব্যবসায়ী মাদ্রসা শিক্ষক ফেরদৌস আলম জানান, উজ্জলকে সুদে ৩ লক্ষ টাকা ধার দেয়া হয়নি। উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সকলেই মিথ্যা কথা বলছে। কোন বৈঠকও হয়নি। বরং উজ্জল কুমার আমার কাছে ৩০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে জমিগুলো লিখে দিয়েছে। জমিগুলো আমি আমার স্ত্রী ও সবুজের স্ত্রী নামে লিখে নিয়েছি। এখন উজ্জল উল্টো কথা বললে তো চলবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সিপন চন্দ্র সিং জানান, আওয়ামীলীগ সরকারের পক্ষে সবসময় আমরা কাজ করছি। সরকারও আমাদের জন্য কাজ করছে। কিন্তু কতিপয় লোক আমাদেরকে সংখ্যালঘু বলে নানাভাবে নির্যাতন করছে। আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করে যেটা জেনেছি তা হলো উজ্জল কুমার একজন মানসিক রোগী। সুদের টাকা দিতে না পারায় তাকে হত্যার হুমিসহ নানাভাবে নির্যাতন করে সুদ ব্যবসায়ী জমি লিখে নিয়েছে। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দার পাশাপামি অবিলম্বে সরকারের কাছে দাবী জমিগুলো ফেরতসহ পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেন। নচেত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে