// ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতাঃ
রেলওয়ের অনুমতি না নিয়ে এবং নিয়ম না মেনে কেপিআই ভূক্ত দেশের দর্শনীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের অধীনে সড়ক নির্মাণ কাজে বাগড়া দিয়েছে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) সকালে বিভাগীয় রেলওয়ে কর্মকর্তারা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে রেল নিরাপত্তা বাহিনী এবং রেল পুলিশ সাথে নিয়ে সড়কের নির্মাণ কাজ বন্ধ করেন। এসময় কাজের কিছু অংশ ভেঙ্গে দেওয়ার পাশাপাশি ওই সড়কের মূখ রেলপাত দিয়ে বন্ধ করা হয়। এঘটনায় রেলওয়ে কর্তপক্ষ ছাড়াও ঈশ্বরদী উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার এবং এলাকাবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাই জানিয়ে বলছেন, এখনে রাস্তা নির্মাণ করা রাষ্ট্রদ্রোহিতাপূর্ণ। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।
উপজেলা প্রকৌশল ও রেলওয়ে বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলা প্রশাসকের ঘাট উন্নয়ন তহবিল হতে ঈশ্বরদীতে উপজেলা পরিষদকে এলজিইডি’র মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য ২৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় পদ্মা নদীর তীরে সাঁড়া ইউনিয়নের ‘সাঁড়া রানাখড়িয়া তড়িয়া মহল’ এবং পাকশী ইউনিয়নের ‘বামনগাঁও নৌকা পারাপার ঘাট’ উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একাজের টেন্ডার আহব্বান করা হলে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিলন মো: তন্ময়ের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বামনগাঁও নৌকা পারাপার ঘাট উন্নয়নের কাজ টেন্ডারে প্রাপ্ত হন। উপজেলা প্রকৌশল বিভাগের আয়োজনে গত ১১ জুন নবাগত উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুবীর কুমার দাশ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে নদীর ঘাট হতে ২০৭ মিটার রাস্তা নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। অনুমতি না নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে রাস্তা নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত আরসিসি পিলারসহ নির্মাণাধীন অন্যান্য কাজ রেল কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার গুড়িয়ে দেয়। এঘটনায় রেল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকার প্রশাসনের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, যে স্থানে ঘাট উন্নয়নের কথা বলে পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে এ ঘাট টেন্ডারে উল্লেখিত ঘাট নয়। টেন্ডারে উল্লেখিত বামনগাঁও নৌকা পারাপার ঘাট অনেক আগেই ভাঙ্গণে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা না করে এবং কোনরূপ পূর্বঅনমতি না নিয়ে কেপিআই ভূক্ত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা নির্মাণ করা হলে ব্রিজের পিলার, গার্ডার ও গাইড ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও শতাধিক বছরের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও দর্শণীয় এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। হেরিটেজ এলাকার কোন পরিবর্তন রাষ্ট্রিয় সিদ্ধান্তের বিষয়।
উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ বলছে, যে স্থানে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে সেটি আদৌ রেলওয়ের ভুসম্পত্তি কিনা সেটা ভুমি অফিস যাচাই-বাছাই করে দেখছে। ওই এলাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে এবং স্থানীয় পর্যটকরা নিয়মিত সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসে। বৃষ্টি হলে মাটি কর্দমাক্ত হলে লোক চলাচল ব্যাহত হয়। যেকারণে রাস্তা পাকা করা হচ্ছিল।
স্থানীয়রা বলছেন, কোথাকার টেন্ডরের কাজ কোথায় করা হচ্ছে সেটা দেখার কি দরকার। রাস্তা নির্মাণ হলে পর্যটকদের যাতায়াতে সুবিধা হবে। অন্যরা বলছেন, হার্ডিঞ্জ সেতু এলাকায় ব্যবসার জন্য এবং পাশে স্তুপিকৃত অবৈধ বালু মহলের বালু নির্বিঘ্নে পরিবহণের জন্য পরিকল্পনা করে এ রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাকশী প্রান্তের ব্রীজের নীচে ১ নং গার্ডার হতে ৩ নং গার্ডার পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল।
এবিষয়ে রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী (ডিইএন-২) বীরবল মন্ডল বলেন, আরসিসি কলাম করে এবং ঢালাই দিয়ে যে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছিল সে কাজ সকালে আমরা ভেঙ্গে দিয়েছি। সেসময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যারা তৈরী করেছিল, তারা ব্রিজ রক্ষার জন্য প্রায় দেড় কিলোমিটার দূর হতে গাইড ব্যাংক নির্মাণ করেছে। এই রাস্তা নির্মাণের ফলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পিলার, গাইড ব্যাংক ও গার্ডার ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, যে দুটি ঘাট উন্নয়নের জন্য উপজেলা পরিষদে অনুমোদন ও টেন্ডার হয়েছে তারমধ্যে বামনগাঁও নৌকা পারাপার ঘাট রয়েছে। এতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচের কথা বলা নেই। যে ঘাটের কথা বলে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে, মূলত: এটি স্বীকৃত কোন ঘাট নয়। তাহলে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে কেন তারা রাস্তা নির্মাণ করছে। পাকশীর ইউনিয়নের বামনগাঁও মৌজা অনেক আগেই নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বামনগাঁও নৌকা পারাপার ঘাট কোথায় ?
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহ সূফি নূর মোহাম্মদ বলেন, কেপিআইভূক্ত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নীচে রাস্তা নির্মাণ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এ কাজ করে রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় ডেকে আনার প্রচেষ্টা চলছে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে (বিশেষ করে বালু পরিবহনের ব্যবসা) ঝুঁকিপূর্ণ ওই স্থানে যাতায়াতের অবাধ ব্যবস্থা করে এমনকি বিভিন্ন ধরণের মোটর ভেহিকেলও নিয়ে আসা হবে। এরইমধ্যে বালু মহলের কারণে গাইড ব্যাংকের কোন কোন স্থান ভেঙ্গে ফেলেছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রাষ্ট্রিয় সম্পদ এবং উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগের অনিবার্য স্থাপনা। এঘটনার জন্য উপজেলা প্রকৌশলী শতভাগ দায়ী জানিয়ে ডিআরএম বলেন, এখন আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অস্তিত্বের প্রশ্নের মূখোমূখি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজকে রক্ষা করতে চাই। এঘটনায় থানায় এজাহার দাখিল করা হবে বলে জানান তিনি।
ঈশ্বরদী উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবীর বলেন, রাস্তা নির্মাণ কিছুই না, সিম্পল একটা জিনিস। ওইখানে একটা ঘাট রয়েছে। ঘাটে একটি যাত্রী ছাউনি এবং রাস্তার কাজ করছি। কাদার কারণে মানুষ হাটতে পারে না। রেলওয়ে কাজ করতে না দেওয়ায় আপাতত: বন্ধ রয়েছে। কাজ করতে না দিলে এটা আমরা অন্য ঘাটে স্থানান্তর করবো। তবে এসি ল্যান্ড অফিসে কাগজপত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে। শুনেছি ওই জায়গা রেলের না, নদীর খাস জমি। বামনগা ঘাট প্রসংগে তিনি বলেন, নদী ভাঙ্গার কারণে ঘাট পরিবর্তন হয়। এখন আমরা যে ঘাট পেয়েছি সেখানেই কাজ করছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুবীর কুমার দাশ বলেন, আমি নতুন এসেছি। প্রকৌশল বিভাগ থেকে ওইখানে রাস্তা নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা বলা হলে গত রবিবার উদ্বোধন করা হয়। রেলওয়ের বাঁধার কারণে কাজ বন্ধ হয়েছে। এসিল্যান্ড অফিসকে বলা হয়েছে,ওই জায়গা আসলে কার সেটা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করতে। সার্ভেয়ারকে দিয়ে জরিপ করে পরবর্তীতে বিস্তারিত পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। ততোদিন কাজ বন্ধ থাকবে।
কাজের ঠিকাদার ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিলন মো: তন্ময় জানান, ইজিপি টেন্ডারে লটারির মাধ্যমে কাজ পেয়েছি। এটি আমার জীবনের প্রথম ঠিকাদারি কাজ। প্রকৌশল বিভাগের সাথে কথা বলে গত রবিবার লেআউট দিয়ে কাজ শুরু হয়। এখন যেটা দাড়িয়েছে ওই জমি রেলের, না উপজেলার খাস জমি। এটাই দেখার বিষয়।
পাকশী ইউপি’র চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিন্টু বিশ্বাস বলেন, আমরা রাস্তার কাজ হওয়ার পক্ষে। এখানে দেশ-বিদেশ হতে অনেক পর্যটক আসেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ. পদ্মা নদী ও পাকশীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। এটি ঐতিহাসিক স্থান। বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত হলে সেখানে চলাচল করা যায় না। এ যায়গায় রাস্তা হলে খুবই ভালো হয়। এটা হেভি কোন রাস্তা না, যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ক্ষতি হবে। শুধু পথচারীদের চলাচলের জন্য। জনপ্রতিনিধিসহ আমাদের এলাকার সকলেরই চাহিদা রাস্তা নির্মাণ হোক।