// সঞ্জু রায়: কোভিড-১৯ মোকাবেলা ছিল বিশ^ব্যাপী এক অঘোষিত যুদ্ধের মতো। মহামারি করোনাভাইরাস যখন নিজের সর্বোচ্চরুপ ধারণ করে ফেলে বিশ্বব্যাপী তখন উন্নত দেশগুলোকেও হিমশিম খেতে হয়েছে তা মোকাবেলায়। অনেক ধনী রাষ্ট্রকেও দেখতে হয়েছে কোভিডে প্রাণ হারানো লাশের সারি কিন্তু করার কিছুই ছিলো না। তবে এসময় স্থাপিত হয়েছে আন্তঃদেশীয় বন্ধুত্বের এবং প্রমাণ করার সুযোগ হয়েছিল কে কার সত্যিকারের আপন। এমতাবস্থায় মহামারিকালীন সময়ে এক ভিন্ন মৈত্রী স্থাপিত হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ এর মাঝে। ‘নেইবারহুড ফাস্ট’ নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে ভারত যেখানে প্রতিবেশীদের মধ্যেও ‘বাংলাদেশ ফাস্ট’ প্রত্যয়ে সবসময় বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় ভারত সরকার। এর ফলে, বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বহুমুখী এবং একে অপরের জাতীয় উন্নয়নের সম্পূরক ভূমিকা পালন করে চলছে। করোনাকালীন সময়ের দুই দেশের বন্ধুত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস’ যা করোনা মহামারি শেষ হওয়ার পরেও যুগের পর যুগ মানুষ মনে রাখবে।
২০২১ সালের মার্চ মাসের মধ্যভাগে করোনার ২য় ঢেউ ভারতে বেশ ব্যাপকভাবে হানা দেয় যেখানে পুরো ভারতজুড়ে মানুষ অসহায়ত্বের মধ্যে পরে যায়। প্রতিদিন একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছিলো এবং শ্মশানজুড়ে ছিলো শুধু লাশের সারি। যদিও ভারত সরকারের দূরদর্শিতায় এবং তাৎক্ষনিক পদক্ষেপে এই অবস্থার দ্রæততম সময়ে উন্নতি ঘটে। তবে ভারতের এই স্বল্প সময়ে বিপদকালীন পরিস্থিতিতে কিন্তু বাংলাদেশ সরকারও তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ভারতের পাশে দাঁড়ায়। মে মাসের শুরুতে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভাইরাল ইনজেকশন, ওরাল অ্যান্টিভায়াল, ৩০ হাজার পিপিই কিট, সাত হাজার জিংক, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘সি’ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ট্যাবলেট ভারতকে পাঠানো হয়। অবনতিশীল কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় তা ছিলো পারস্পরিক বন্ধুত্বের স্মারক। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং ভারত যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছিল তখন আবার বাংলাদেশের করোনাকালীন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। এ সময়ে প্রথমবারের মতো ভারতীয় রেলওয়ের অক্সিজেন এক্সপ্রেস তরল মেডিকেল অক্সিজেন (এলএমও) রেলওয়ে কন্টেইনারে করে বাংলাদেশে পরিবহণ করেছে। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে ২০২১ সালের ২৪ জুলাই টাটানগর থেকে প্রথম অক্সিজেন এক্সপ্রেস বাংলাদেশে পাঠানো হয়। কোভিডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াইয়ের সমর্থনে ভারতীয় রেলওয়ে বাংলাদেশে ২০টি অক্সিজেন এক্সপ্রেস ট্রেন পরিচালনা করেছে। করোনা পরস্থিতি মোকাবেলায় এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছিলো দারুণ এক সুখবর। ২০২১ সালের ২৪ জুলাই ভারত থেকে ২০০ মেট্রিকটন তরল অক্সিজেন নিয়ে বেনাপোল বন্দরে পৌঁছায় ‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস’। এটি ছিলো অক্সিজেন এক্সপ্রেসর দ্বিতীয় চালান। এর তিনদিন পর ২৮ জুলাই ভারতীয় রেলওয়ের ‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস’ আরো ২০০ মেট্রিক টন তরল মেডিকেল অক্সিজেন নিয়ে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে। ভারত অক্সিজেন পরিবহনে ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল ‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস’ নামে এই বিশেষ ট্রেন পরিসেবা চালু করে।
শুধু তাই নয় ‘আঁধার ঘুচুক, পরশ থাকুক হৃদয় ভরা’ এই স্লোগানকে ধারণ করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভারতের সহযোগিতা আসে বাংলাদেশে। করোনা মোকবেলায় এক নতুন মৈত্রীতার শুরু করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শুরুতেই ৩০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক এবং ১৫ হাজার হেড-কভার সমন্বিত জরুরি চিকিৎসা সহায়তা পাঠানো হয়। এছাড়াও করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে ডাক্তার, নার্সদের আলাদা প্রশিক্ষণ চালু করেছে ভারত সরকার যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের আলাদা প্রশিক্ষণও দিয়েছে ভারত।
এখানেই থেমে নেই দুই দেশের বন্ধুত্ব, টিকা আবিস্কারের পর খুব দ্রুততার সাথে সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে অক্সফোর্ড আস্ট্রেজেনেকার টিকা পায় বাংলাদেশ এবং উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে একই সময়ে টিকাকরণ প্রক্রিয়া চালু করে কেবল ভারত সরকারের জন্যই। টিকা যখন সোনার হরিণ তখন ভারত সরকার ৩৩ লাখ ডোজ টিকা উপহার দেয় বাংলাদেশকে যা বন্ধুত্বের এক অপার নিদর্শন। ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি ২০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন বিনামূল্যে বাংলাদেশকে উপহার দেয় ভারত, যা তৈরি করেছিলো সিরাম ইনস্টিটিউট। ২৫ জানুয়ারি পৌঁছায় সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির প্রথম চালানের ৫০ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। ২২ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় পৌঁছায় সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা ২০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। ২৬ মার্চ ঢাকায় পৌঁছায় ভারতীয় উপহারের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১২ লাখ ভ্যাকসিন। ৮ এপ্রিল ভারতের সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নরভানে বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের কাছে ১ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন হস্তান্তর করেন।
সর্বোপরি এটি স্পষ্ট যে, দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ভারত। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছে তারা। বাংলাদেশের যে কোনও জরুরী পরিস্থিতিতে ভারত সর্বপ্রথমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এসেছে কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব কৌশলগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। আর তার শুরু বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই। এতে প্রতীয়মান, ভারত সরকার বাংলাদেশের দুর্দিনে ঐতিহাসিকভাবে পাশে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।