ভাঙ্গুড়া (পাবনা) প্রতিনিধি
এসএসসি পরীক্ষার আর মাত্র তিন-চার মাস বাকি। এরই মধ্যে নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলা শহরের অর্ধশত বছরের পুরাতন নারী বিদ্যাপীঠ জরিনা রহিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। ফলে পরীক্ষার ফরম পূরণে এসব শিক্ষার্থীদের আপত্তি জানায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে মারাত্মক সমস্যায় পড়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। অভিভাবকদের মতে, মোবাইলে অতিরিক্ত আসক্ততার কারণে এমন ফলাফল হয়েছে। এরপর মোবাইল ছেড়ে প্রতিদিন অন্তত আট ঘন্টা পড়াশোনা করার শর্তে ওই শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণের অনুমতি দেয়া হয়।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা কেমন পড়াশোনা করছে? তা জানতে গত এক সপ্তাহ ধরে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শিক্ষকদের সাথে নিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছেন বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ও ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মেয়র গোলাম হাসনাইন রাসেল। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বই সহ শিক্ষা উপকরণ নিজ অর্থায়নে পৌঁছে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের কাছে। বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। গোলাম হাসনাইন রাসেল ২০১৮ সালে সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির শ্রেষ্ঠ সভাপতি নির্বাচিত হন।
জানা যায়, ১৯৭০ সালের প্রতিষ্ঠিত উপজেলা শহরে বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন শিক্ষাবিদ আফজাল হোসেন। ২০০৪ সালের দিকে বিদ্যালয়টিতে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতো। ওই বছরে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলী অবসরে যাওয়ায় শওকত আলী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পান। সেসময় কাম্য যোগ্যতা না থাকায় আদালতের শরণাপন্ন হয়ে দীর্ঘদিন সহকারী শিক্ষকের বেতনে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় তিনি বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ করা সহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এতে আকস্মিকভাবে ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ত্যাগ করেন। এক পর্যায়ে ২০০ জনের নিচে চলে আসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শওকত আলী স্ত্রীকে বিতর্কিত দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিয়ান সনদে বিদ্যালয়ে চাকরি দেন। নিজ কক্ষে প্রধান শিক্ষক শওকত আলী শয়ন খাট সহ পারিবারিক সরঞ্জামাদি রাখতেন। তার স্ত্রী বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দিয়ে রান্না ও কাপড় ধোয়া সহ পারিবারিক কাজ করাতেন। একপর্যায়ে বিদ্যালয়ের চত্বরে ওই প্রধান শিক্ষক বাসভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এসব অনিয়মের কারণে রাজশাহী আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস সহ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর একাধিকবার অডিট করে আর্থিক দুর্নীতি সহ নানা অনিয়মে ২০১৫ সালে শওকত আলীকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। তবে সে সময় ম্যানেজিং কমিটিকে হাত করে স্বপদে এক বছরের অধিক সময় বহাল থাকায় শিক্ষা অধিদপ্তর ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করেন। এরপর ২০১৭ সালে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় অভিভাবকদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে যান শওকত আলী। কিছুদিন পর তিনি দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় প্রায় দুই সপ্তাহ কারাভোগ করেন। মামলাটি এখনো আদালতে চলমান রয়েছে।
এদিকে শওকত আলী বহিস্কার হলেও স্থানীয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠাতা আফজাল হোসেনের ছেলে প্রকৌশলী ডক্টর জাহিদ হাসান ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ শুরু করেন ও শিক্ষার্থী বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তিনি সফলতাও পান। বর্তমানে বিদ্যালয়ে প্রায় পাঁচশত শিক্ষার্থীর পড়াশোনা করছে। এরপর চলতি বছরে ভাঙ্গুড়া পৌরসভার মেয়র গোলাম হাসনাইন রাসেল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর ধারাবাহিকতায় আগামী বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলের জন্য রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
অভিভাবকরা বলেন, বিদ্যালয়ের সভাপতি রাসেল পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাছাড়া তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সচেতন করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খোঁজখবর নিচ্ছেন। এটি আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের ও বিরল ঘটনা মনে হয়েছে। তার উদ্যোগ ে বিদ্যালয়টি হারানো গৌরব ফিরে পাবে বলে আশা করি।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফারুক হোসেন বলেন, নারী বিদ্যাপীঠ হিসেবে ঐতিহ্য ও প্রশংসার দাবিদার ছিল প্রতিষ্ঠানটি। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর জন্য প্রত্যেক শ্রেণীতে চারটি করে শাখা ছিল। কিন্তু গত ২০০৫ সাল থেকে একটানা এক যুগ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে অভিভাবকরা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করছিলেন না। ফলে বিদ্যালয়টি চরম সংকটে পরে। এরপর গত কমিটির সভাপতি ডক্টর জাহিদ হাসান স্থানীয় সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের সহায়তায় বিদ্যালয়টিতে পড়াশোনার মান উন্নয়ন করে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছেন। এখন বর্তমান কমিটির সভাপতি মেয়র গোলাম হাসনাইন রাসেল মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতে ও শিক্ষার্থীদের মোবাইল ছেড়ে পড়াশোনায় মনোযোগী করতে ব্যস্ততার মাঝেও শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিদিন খোঁজখবর নিচ্ছেন। এতে বিদ্যালয়টি আরো এগিয়ে যাবে।
পৌর মেয়র ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি গোলাম হাসানাইন রাসেল বলেন, বিদ্যালয়টির হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে কাজ করছি। যাতে আবারও অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে এই বিদ্যালয়ে পাঠান। পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করার মাধ্যমে বিদ্যালয়ের প্রতি অভিভাবকদের অনীহা কাটবে। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস সহ সকল সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।
ফটো ক্যাপশন: মঙ্গলবার রাতে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার খোঁজখবর নিচ্ছেন মেয়র গোলাম হাসনাইন রাসেল।