এবাদত আলী
১৯৬৮ সালের দিকে আমি (এই প্রতিবেদক) যে এলাকায় জায়গির থেকে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে লেখা-পড়া করতাম সেই এলাকায় কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। একসময় হঠাৎ করে বাহাদুরপুর, আফুরি ও বৈকুন্ঠপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা দেখা দেয়। প্রথমে রৈকুন্ঠপুর গ্রামে এক বাড়িতে একটি ছোট ছেলে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়। দেখতে দেখতে গোটা গ্রাম ছেয়ে যায়। একই গ্রামে প্রায় ২০-২২ জন মানুষ আক্রন্ত হয় এবং বেশ কয়েকজন মারা যায়। এরপর আফুরি তারপর গোপালপুর আমার জায়গির বাড়ির পাশের বাড়িতে কলেরা রোগ ঢুকে পড়ে। কলেরা সাংঘাতিক ঁেছায়াছে রোগ তাই কেউ কারো খোঁজ খবর নেয়না।
আমরা কতিপয় সাহসি ছাত্র সেই সব রোগীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু আমাদের কাছে তো আর ওষুধ-পথ্য নেই। তাই আমরা ছুটে যাই সদর থানা হেলথ অফিসে। কিন্তু থানা হেলথ অফিসারের কাছ থেকে তেমন আশানুরূপ সহযোগিতা পওয়া যায়না। আমরা তাই পাবনা সদর মহকুমা হাকিম (এসডিও) এর অফিসে গিয়ে জানতে পারি তিনি মফস্বলে আছেন। অগত্যা সিভিল সার্জনের নিকট গিয়ে সব কথা খুলে বলি। তিনি আমাদেরকে বলেন শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কলেরা আক্রান্ত রোগীদের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়না।
কলেরা যখন মহামারি আকারে তখন গোপালপুর গ্রামে একজন ফকির এলেন। তিনি বলতে লাগলেন কলেরা মানুষের রূপ ধরে আসে। এরা ৭ বোন মিলে আক্রমণ করে। তাই তাদেরকে তাড়াতে হবে। গ্রাম বন্ধ করতে সিন্নি দিতে হবে। সেই ফকিরের কথা মত গ্রামের অসহায় মানুষজন তাতে রাজি হলো। তিনি কয়েকটি লম্বা বাঁশ জোগাড় করতে বল্লেন। বাঁশের সঙ্গে সাদা পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হলো। তিনি তন্ত্র-মন্ত্র দোয়া দরূদ পড়ে গ্রামের এমাথা ও মাথা দৌড়াদৌড়ি এবং লাফ ঝাঁপ পাড়লেন। রাতে আতপ চাউলের সঙ্গে দুধ ও চিনি দিয়ে সিন্নি রান্না করে গ্রামের মানুষের হাতে হাতে দিলেন।
তিনি বল্লেন ওরা ৭ বোনের মধ্যে দুই বোন একসঙ্গে এই এলাকায় এসেছে ওরা যাকে খাবার তাকে খেয়েই চলে যাবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা। কলেরা আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমন সময় এলাকার একজন মুরব্বি বলেন, বাবা, এম্বা করে কোন কাম হবিনানে। তোমরা যদি পারো তো কোন সুম্বাদিকের কাছে যাও। আর সুম্বাদিকরা যদি পিপারে এই খবর ছাপায়ে দেয় তাহলি দেখপের পারবে সব অফিসাররা ক্যাম্বা করে বাপ বাপ করে ছুটে আসপিনে। সেই মুরব্বির কথায় আমরা খুবই গুরত্ব দেই। আমরা কজন মিলে একটি অভিযোগ নামা লিখি। কাঠ পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজের নিচে কার্বন ধরে কয়েকটি কপি করি। কিন্তু সাংবাদিকের দেখা পাবো কোথায়?
চাইলেই তো আর সাংবাদিকের দেখা পাওয়া যায়না। তবে এডওয়ার্ড কলেজের একজন ছাত্র রবিউল ইসলাম রবি (গ্রামের বাড়ি গাঁতি আটমাইল) দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক বলে আমি জানতাম। কিন্তু এদিন কলেজে গিয়ে বহু খুজাখুজি করেও তার দেখা পেলামনা। তার শহরের বাসার ঠিকানা না জানায় গেলাম পাবনা আলীয়া মাদরাসা মার্কেটে চিত্রাকাশের সাংবাদিক টিআইএম রিয়াজুল করিম হিরোকের খোঁজে। তাকেও পাওয়া গেলনা। অগত্যা আমরা পাবনা প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে শহরের নতুন গলিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম সাংবাদিকরা সন্ধ্যার পরে আসবেন।
হঠাৎ মনে হলো একজন সাংবাদিকের কথা। তিনি হলেন মির্জা শামসুল ইসলাম। বেশ কিছু দিন আগে পাবনা মডার্ণ আর্ট প্রেসে (আবুল হোসেন ওরফে আবু মিয়ার প্রেস) তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো। তিনি তখন দৈনিক পাকিস্তানের ষ্টাফ রিপের্টার। পাবনা শহরের নতুন গলিতে গিয়ে সরু একটি সিড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে প্রথমেই যার দেখা পাওয়া গেল তিনি হলেন সাংবাদিক রণেশ মৈত্র। আরো সাক্ষাৎ পাই সাংবাদিক মির্জা সামছুল ইসলামের। তাঁরা আমাদের হাতের কাগজ খানা নিয়ে অতি উৎসাহ ভরে বল্লেন, ছোট ভাইরা তোমরা যাও। আমরা এর চুড়ান্ত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
পাবনা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকগণ সেদিন কেমনভাবে কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তা জানিনা তবে একদিন পর সকাল বেলা এসে হাজির হলেন থানা হেলথ অফিসার। সঙ্গে তার দলবল। এর কিছুক্ষণ পর এলেন পাবনার সিভিল সার্জন। কলেরা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় তার লোকজন ওষুধ-পথ্য নিয়ে কাজে নেমে পড়লো। গ্রামের সকল মানুষকে কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি বাসি-পচা খাদ্য না খাওয়া এবং ঘর-দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দিলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলেন পাবনার ডিসি একেএম হেদায়েতুল হক সিএসপি। রাধানগর মক্তব থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে ময়দানপাড়া এসে তাঁর জিপ গাড়ি রেখে ময়দানপাড়ার জোলা নৌকাতে পার হয়ে কমলা বিলের কাদামাটি মাড়িয়ে জমির আইল বেয়ে পায়ে হেঁটে তিনি বাহাদুরপুর গ্রামে পৌঁছলেন। তাঁর সাথে ছিলেন সদর মহকুমা এসডিও। তারা এলাকার লোকজনকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে, আপনাদের কোন ভয় নেই। যতদিন পর্যন্ত এই এলাকা থেকে কলেরা একবারে নির্মুল না হবে ততদিন আমাদের মেডিকেল টিম ক্যাম্প করে এখানে থাকবে। উপযুক্ত চিকিৎসা ও সেবায় আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ্য হয়ে উঠলো। নতুন করে আর কেউ আক্রান্ত হলোনা। বলতে গেলে এই এলাকা কলেরা মুক্ত হলো। এহেন ঘটনার অবতারনায় এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। সেই মুরুব্বী আমাদেরক বলেন দেখিছ্যাও বাপু ঠ্যালার নাম বাবাজি।
পরে অবশ্য জেনেছিলাম পাবনার সাংবাদিকগণ পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশ করার ফলে ঢাকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে ডিসি ও সিভিল সার্জনের উপর দারুন চাপ আসতে থাকে। তাই তারা ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। যেকাজ আমরা ক’দিন ধরে ঘোরাঘুরি করে সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম সেকাজ অতি সহজেই সাংবাদিকদের দ্বারা সম্পন্ন হওয়ায় এলাকার মানুষজন যেমন খুশি হলেন তেমনি সাংবাদিকতা করার প্রতি আমি দরুনভাবে অনুপ্রাণিত হলাম। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট তাং ২১ /১২/২০২২