ফেলে আসা দিন গুলো-১৪

এবাদত আলী
আমি ১৯৬৬ সালে আর এম একাডেমি হতে এসএসসি পরীক্ষা পাশ করার পর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হই। আরএম একাডেমিতে অধ্যয়নকালে আমি ছাত্রলীগের জিএস ছিলাম। সেই সুবাদে পরিচয় হলো ছাত্র লীগ নেতা সোহরাব উদ্দিন সোবা, মোহাম্মদ নাসিম, ফজলুর রহমান পটল, তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, আব্দুস সাত্তার লালু, রফিকুল ইসলাম বকুল, সালাউদ্দিন আহমেদ সোহেল, আমিনুল ইসলাম মুক্তা, গোলাম সরোয়ার খান সাধন, লায়লা আরজুমান্দ বানু বিথি, কামরুজ্জামান, সৈয়েদা নুরজাহান কিসমত, মাসুম আহমেদ, শাহজাহান আলী প্রমুখের সঙ্গে। আরেকজন উল্লেখযোগ্য নেতা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। যিনি আরএম একাডেমিতে আমার সহপাঠি ছিলেন ।
এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তির পর থেকে কলেজে যতগুলো সাহিত-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতো তার বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের ঘোষক থাকতাম আমি। প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপনায় সকলেই আমাকে দারুন পছন্দ করতেন।
এসময় ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। তৎকালীন পুবর্-পাকিস্তান থেকে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব, নুরুল আমিন, মাহমুদ আলীসহ বহু নেতা সে বৈঠকে যোগদান করেন। বৈঠকে বাঙালি জাতির পক্ষে শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসুচি পেশ করেন। শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠক থেকে ঢাকায় ফিরে এলেন এবং বিমান বন্দরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ হচ্ছে ৬ দফা। তিনি ৬ দফা কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিলেন।
শেখ মুজিব ৬ দফার পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষে সারা ুর্ব-পাকিস্তান চষে বেড়াতে লাগলেন। এরই অয়শ হিসেববে তিনি পাবনা সফরে আসবেন এবং পাবনা টাউন হলে জনসভায় িিতনি ভাষণ দিবেন। তাঁর আগমণে আমাদের অর্থাৎ ছাত্র লীগের নেতা-কর্মীদের ডাক পড়লো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনে বাংলার উদীয়মান নেতা। তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভুষিত হননি। হননি জাতির পিতা। কিন্তু এই উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবের প্রতি সাধারণ মানুষের গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ জন্মাতে থাকে। তাই তিনি যেখানেই যান সেখানেই মাছির চাকের মত জনতা তাকে ঘিরে ধরে। তার কথা শুনতে চায়।
এসময় আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, গোলাম হাসনায়েন, আ্যাড. আমিনুদ্দিন, আ্যড. আমজাদ হোসেন, আব্দুর রব বগা মিয়া, আব্দুল গনি, আবু তালেব খন্দকার, আব্দুল মান্নান, ওয়াজি উদ্দিন খানসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে ডেকে নিয়ে মিটিং করলেন। টাউন হলের জনসভার দিন শেখ মুজিবের আগমণ উপলক্ষে আমাদেরকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হলো।
আমি দায়িত্ব চেয়ে নিলাম জনসভা শুরুর আগে মাইকে লোকজনকে সভাস্থলে আসার জন্য বার বার আহবান করার। পাবনা শহরের একমাত্র মাইক ওয়ালা ‘ হেদায়েত মাইক সার্ভিস’ হতে মাইক সেট ভাড়া করা হলো।

পাবনা টাউন হল ময়দানে মিটিং হবে বিকাল বেলা। মাইকে ঘোষণার সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয় সেজন্য আমি দুপুরের আগেই শুন্য ময়দানে গিয়ে মাইক নিজের দখলে নিলাম।
আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অতি কাছ থেকে দেখার সে এক অপুর্ব সুযোগ। তিনি আমাদের সাথে হাত মিলালেন। কাঁধে হাত বুলিয়ে দিলেন। এ অবিস্মরণীয় স্মৃতি জীবনেও ভুলবার নয়।
১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা থেকে আরিচা- নগরবাড়ি হয়ে পাবনায় আগমণ করেন। এদিন আরিচা থেকে গোমতি নামে ফেরিতে উত্তর বঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত নগরবাড়ি ফেরিঘাটে পৌঁছান।
নগরবাড়ি ঘাটে হাজার হাজার জনতা তাঁকে সংবর্ধনা প্রদান করেন। তিনি সেখানে জনতার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।
সড়ক প্েযথ তাঁকে পাবনা শহরে নিয়ে আসা হয়। তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার বাসায় ওঠেন এবং দুপুরের খাবার খান। বিকালে পাবনা শহরের প্রাণ কেন্দ্র পাবনা সদর হাসপাতাল ও অন্নদা গেবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির পাশে পাবনা টাউন হল ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দান করেন।
শেখ মুজিবের প্রতি তখন সাধারণ মানুষের কৌতহলের যেন সিমা নেই। কে এই ব্যক্তি যিনি বাঙালিদের সার্থের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই তাঁর ভাষণ শোনার জন্য দলে দলে মানুষ টাউন হলে আসতে থাকে। গোটা টাউন হল লোকে লোকারন্য হয়ে পড়ে। মাঠ উপচে আব্দুল হামিদ রোডও লোকে লোকারন্য। যান বাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ আমজাদ হোসেনের সভাপতিত্বে এবং জেলাা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার পরিচালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজ উদ্দি আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরি এম এন এ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ অ্যাডভোকেট ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ।
ভাষণে তিনি বলেন, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বাস্তব ক্ষেত্রে প্রমণিত হয় পূর্ব বাংলা সম্পুর্ণভাবে অরক্ষিত ছিলো। তখন থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ সামাজিক, সাং¯কৃতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতায় পুর্ব বংলার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ন্যুনতম উন্নতি করার প্রচেষ্টা গহণ করেনি। বাঙালিদের প্রতি জাতিগত এই বৈষম্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে আমি তাই গত ৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ‘ সর্ব দলীয় জাতীয় সংহতি পরিষদে’ বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছি। ৬ দফা প্রস্তাব কোন রাজনৈতিক দরকষাকষির ব্যাপার নয় ৬ দফা হলো সাড়ে ৫ কোটি পুর্ব পাকিস্তাুিনর বাঁচা মরার দাবি। এই ৬ দফা দাবির প্রতি আপনাদের পুর্ণ সমর্থন আছে কি? হাজারো কন্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে আছে আছে। তিনি দ্যার্থহীন কন্ঠে বলেন, আইয়ুব খান সাহেব আপনার বন্দুক আছে জানি এই আমি শেখ মুজিব বলছি আমার এই বুক আছে (শাটের বোতাম খুলে নিজের বক্ষ উন্মোচন পুর্বক) চালান গুলি। আমি বুক পেতে দিলাম। আমি আর কিছু চাইনা। বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার চাই। পাবনার জনসভায় ৬ দফা ঘোষণার কয়েকদিন পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়।(চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট