সামাজিক দূরত্বের নামে এ কী কাণ্ড!

করোনাভাইরাসের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্ব এক সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। বৈশ্বিক মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব (সোশ্যাল ডিসট্যান্স) বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটিই করোনা মোকাবিলার অন্যতম উপায়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। এমতাবস্থায় সারাদেশে সশস্ত্রবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, সড়ক-নৌ-আকাশসহ সকল পথে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ছুটিপ্রাপ্ত লোকজন সরকারী নির্দেশ মেনে ঘরে বন্দি হয়েছে, শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছে। কিন্তু দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মূলত তাদের যতসামান্য চলাচল করতে দেখা গেছে, যাচ্ছে। কেউ রিক্সা-ভ্যান নিয়ে বের হয়েছে, কেউ ফেরি নিয়ে বের হয়েছে, ইত্যাদি। তাদের উদ্দেশ্য নিয়মভঙ্গ করা নয়, আহার সংগ্রহ করা। সাধারণ মানুষকেও নিত্যপণ্যের প্রয়োজনে দোকানপাটে ছুটতে দেখা গেছে। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দায়িত্বরত পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেককে নিপীড়ন-নির্যাতন করেছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি ভিডিও, ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, মূলধারার গণমাধ্যমে এসেছে। ধিক্কার জানিয়েছে সচেতন মহল।

বিশ্বের অনেক দেশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হলেও বাংলাদেশে সরকারীভাবে এমন কোনো ঘোষণা আসেনি। দেশে যদি ‘লকডাউন’ ঘোষণা না করা হয়, তবে সাধারণ জনগণ, খেটে খাওয়া মানুষকে এভাবে লাঞ্ছনা করা দুঃখজনক। এ ধরনের অপকর্মে খোদ তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাধারণ জনগণকে কারণ ছাড়া এভাবে সম্মানহানি করা পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নয়।’ আমাদের কথাও তাই। পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী যদি সাধারণ জনগণকে ঘরের বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত না করতে পারে, মানুষকে সচেতন করতে না পারে, তবে এটি তাদের চরম ব্যর্থতা। তাই বলে জনগণকে লাঠিপেটা, কানধরে উঠবস করানোর মাধ্যমে সে ব্যর্থতার আক্ষেপ মেটাতে হবে? করোনাভাইরাস মোকাবিলাকে কেন্দ্র করে অনলাইন মাধ্যমে পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনীর ন্যাক্কারজনক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের যেসব ভিডিও, ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, তা জনঘ্যরকম অপরাধের উদাহরণ, যেন দেশে আবার ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নেমে এসেছে। পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী যেখানে জনগণকে বলবে- করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কী কী করা উচিত, কী কী উচিত নয়; বিপরীতে দেখামাত্রই তাড়া করা হচ্ছে। প্রশ্ন হল- দেশে তো কোনো কারফিউ বা জরুরি অবস্থা চলছে না, তাহলে কেন পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষকে মারধর করবে?

আমি প্রথম থেকেই আশঙ্কা করে আসছি, বাংলাদেশের পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পুলিশ কর্তৃক জনগণকে মারধর করার কৌশলকে রপ্ত করেছে। শুরু থেকেই ভারতের বেশকিছু ভিডিও অনলাইন মাধ্যমে ভাইরাল হয়, সেসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে- ভারতীয় পুলিশ গণহারে লোকজনকে পিটাচ্ছে। বাসায় থাকে না কেন তাই? মাস্ক পরে কেন তাই? এটা আইনসম্মত? তবে ‘মানসিকভাবে’ (আইনগত নয়) অনেকের (জনগণের এক অংশের) সায় পাচ্ছে তারা, তা বোঝা যাচ্ছে। কারা সায় দিচ্ছে জানেন? হিন্দু ধর্মের লোকজন। ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার কট্টরপন্থী হিন্দু। তার হুকুম হোক আর তাকে মনোপুক্ত করতেই হোক- করোনাভাইরাসকে মোকাবিলার ইস্যুকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছে। ভারতে চলমান সাম্প্রতিক দাঙ্গার মধ্যে এটি যেন নতুনমাত্রা যোগ করেছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে- জুম্মার নামাজ পড়া শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়া লোকজনদেরকে পেটানো হচ্ছে। এটিই প্রমাণ করে- নরেন্দ্র মোদি সরকারের চক্রান্ত বিদ্যমান, হিন্দু ধর্মাবলীদের সমর্থন বিদ্যমান। মুসলমান নির্যাতনের কূটকৌশলের দ্বারা বাংলাদেশের পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী প্রভাবিত হয়েছে, শতভাত নিশ্চিত করে বলা যায়। এমনটা হলে তো চলবে না! সাধারণ জনগণকে জিগ্যেস করতে হবে- আপনার ঘরে কী আহার আছে? এই প্রশ্ন যদি তারা করতে সক্ষম না হয়, তবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণকে বিনাকারণে প্রহার করার অধিকার তারা রাখে না।

দেশব্যাপী অঘোষিত ‘লকডাউন’-এ ইতোমধ্যে দেশের রাস্তাঘাট, দোকান-পাট, হাট-বাজার বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। কোম্পানিগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। কর্মীরা সাধারণ ছুটিতে গ্রামে গিয়ে মানববেতর জীবন কাটাচ্ছে। দেশের সবকিছু ‘লকডাউন’ হলেও কারও পেটকে ‘লকডাউন’ করা সম্ভব হচ্ছে না। ‘লক ডাউন’-এ করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকা যাচ্ছে, কিন্তু পেটে ক্ষুধার যন্ত্রণা নানান রোগের জন্ম দিয়ে চলেছে বৈ কি। এই অবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষদের নির্মমভাবে পিটিয়ে, কানে ধরে উঠবস করিয়ে কী করোনাভাইরাস মোকাবিলা সম্ভব? করোনাভাইরাস যতটা না দেশের মানুষকে আক্রান্ত করতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশি আক্রমণ করে বসেছে ক্ষুধা, দারিদ্রতা, কর্মহীনতা। করোনাভাইরাস জনমনে যতটা না ভয় সৃষ্টি করতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশি ভয় সৃষ্টি করেছে পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনী। ভয় আর সচেতনতা এক বিষয় না। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ পেটের দায়ে দঁড়ি ছিড়ে বাহিরে বের হচ্ছে, করোনাভাইরাসের মুখ দেখতে নয়। বিষয়টা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করা উচিৎ।

দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কতজন বিত্তশালী এগিয়ে এসেছে? হোম কোয়ারান্টাইনের অন্তরালে বসে এম.পি-মন্ত্রীরা বেফাঁস বক্তব্য ঝেরে মানুষের হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে। করোনাকালে এমন হাসি ঘরবন্দিদের জন্য প্রদেয় বটে! বিপরীতে পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনীর খামখেয়ালীপনা দেখে রীতিমত মানুষজন জর্জড়িত, অবাক। কিছু লোকজন এসবকে সমর্থন দিয়ে সামাজিক মাধ্যম গরম করে চলেছে। তারা তো জানে না, নিজের ঘরের হাঁড়িতে ভাত থাকলেও ভুক্তভোগি মানুষগুলোর আহার জুটছে না। দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তবুও আমরা পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে চাই। সরকারের ত্রাণভাণ্ডার থেকে এঁদের মাধ্যমে অসহায়, কর্মহীন মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার মাধ্যমে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে রাখা হোক। নচেত কোনো কিছুতেই মানুষকে ঘরে বন্দি রাখা সম্ভব হবে না। সম্প্রতি দেশে করোনাভাইরাসে নতুন কোনো আক্রান্তের খবর আসেনি, কেউ মারা যায়নি। এটি খুশির খবর। এমন খবর দু’একদিন এলে সবাই তখন কাজে নেমে পরবে, খাদ্যের সন্ধান করবে। তখন কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। কেননা, করোনাভাইরাসের করালগ্রাস এখনও বিশ্বকে কাঁপাচ্ছে। এ মহামারীর অবসান হয়নি।

লেখক : মোহাম্মদ অংকন, গল্পকার ও কলামিস্ট, ঢাকা।