ও আমার দেশের মাটি

কর্মব্যস্ততার কারণে এবারের বিজয় দিবস নিয়ে লিখা সম্ভব হয়নি। মূলত অতি ব্যস্ততায় কিছুটা বিস্মৃতিও এসেছিল। বিজয় দিবসের পূর্ব রাতে সহধর্মিনী বললেন, ‘বিজয় দিবস নিয়ে কিছু লিখনি?’ প্রবোধ দিয়ে বললাম সময় করতে পারিনি। নিজেকে অনেকটা অপরাধীও বোধ হলো। কারণ সব সময় বিজয় দিবস নিয়ে লিখি। আর তাতে জীবন দানকারী শহীদ, বুদ্ধিজীবী, সভ্রম হারা মায়েদের কথা, পঙ্গুসহ সকল বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধার গুণগান থাকে। যাঁরা জীবন দিয়ে এদেশকে স্বাধীন করেছে, গর্বের প্রতীক লাল-সবুজের পতাকা এনে দিয়েছে বাঙালি জাতিকে। যাঁরা দেশের মাটির পবিত্র গন্ধ শুকার সুযোগ করেছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ঘাটতির সুযোগ নেই।
এ অপরাধবোধকে লাঘব করার মানসে মাতৃভূমিকে চিন্তা করে এ লিখা। পৃথিবীতে আর কোন জাতিই সম্ভবত এতো দীর্ঘ সময় পরাধীনতার পদতলে পিষ্ট হয়নি। বৃটিশদের দ্বারা দু’শত বছর, পাকিস্তানি দ্বারা চব্বিশ বছর এ কাল। আমরা বাঙালি জাতি দীর্ঘ সময় নি®প্রভ ছিলাম। সম্ভিত ছিল না অসঙ্গত কারণেই হয়তো। একটি মানুষ যদি শারিরীক, মানসিক সুস্থ থাকে, তাহলে তার বোধদয়, চৈতন্যপ্রভা দীর্ঘ সময় সুপ্ত থাকার পর কোন না কোন সময় তা জেগে ওঠে। ‘গীতা’ নামক উচ্চাঙ্গের ধর্ম গ্রন্থে লিখা আছে যখন অধর্ম, অন্যায়ের প্রভাব বর্ধিত হয়, আর সজ্জন গোষ্ঠীর অশান্তি তৈরী হয় তখন কিছু মানব বা মহামানব আবির্ভুত হয় এ গুলো দমনের উদ্দেশ্যে। আমাদের পূণ্য বঙ্গভূমির ক্ষেত্রে এর সবটুকুই নিহিত ছিল। এর থেকে নি®কৃতি পেতে আবির্ভুত হন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানী সাহেব, জাতীয় চার নেতা, শহীদ বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তাঁরাই বিভিন্ন সুকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্রমে এ জাতিকে স্বাধীন, সার্বভৌম অবস্থায় উপনীত করেন। তাঁরা আজ কায়িকে নেই। সু² অবস্থায় সদা বিরাজিত বাঙালি জাতির ধ্যানে, জ্ঞানে। শৃঙ্খল বিহীন এ জাতি আজ মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় অবাধ গতি সম্পন্ন।
আজ আমরা দেখতে পাই নয়ন বিমুগ্ধ সোনালী ধানের দিগন্ত বি¯তৃত ফসলের মাঠ, ভোরের রক্তিম সুর্যোদয়, মুক্ত ব্যোমে সাদা বলাকার ঝাঁক বেঁধে চলা। ফুল-ফলে, ধন-ধান্যে, শস্য সম্ভারে পূর্ণ এ সোনার বাংলা। মায়ের ক্রোড়ে শিশুর আবিলমুক্ত হাসি। জগতে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? অনেক কষ্টের পর কোন দুর্লভ বস্তু লাভ হলে, তা হয় অন্তরের ধন।
একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বিজয় মাল্য ধারণ পূর্বক বিশ্বমঞ্চে আদৃত হয়। আর মানচিত্রে নিজের নামটুকু লিখাতে সক্ষম হয়। একটি স্বাধীন দেশের পবিত্র মৃত্তিকা স্বর্ণের চেয়ে মূল্যবান। এর প্রতিটি অঙ্গ যেমন- নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর, গাছ-পালা, পশু-পাখি, নদ-নদী, অনুভব ও অনুভূতি প্রকাশের সেরা মাধ্যম শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ এ সব মিলে যেন একটি স্বর্গরাজ্য এ মাতৃভূমি। সকল প্রেম, সকল আনন্দ যেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মধ্যে। আমরা দেশ মাতৃকার নিকট কি চাই? একটু প্রশান্তি। এখানে কোন বিনিময় নেই। যেখানে বিনিময় সেখানে লাভ, লোভ, চাওয়া-পাওয়া নিহিত থাকে। আর অশান্তিও সেখানে। একটু কম-বেশি হলেই দ্বন্ধ। আমাদের স্বর্গদপী এ গরীয়সী আমাদের কাছে কি প্রত্যাশা করে? একটু প্রেম একটু ভালোবাসা। কাজেই আমরা যেন তা উজার করে দিতে পারি এ দুখী মাতৃভূমির পদতলে।
এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিভ্রমন কালে প্রাকৃতিক নৈসর্গ মনকে ভলিয়ে তোলে। নয়ন জুড়ানো বিমোহিত, এ রূপ যেন জগতে বিরল। হেমালঙ্কার শোভিত এর রূপ গর্বে যেন শিরোমণি। তাই মনে পড়ে মন মাতালো সে সঙ্গীতের কলিগুলো, ও আমার দেশের মাটি তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা। খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি। এই বাংলা আমার মা আমি তার সন্তান। আমি এমনিতেই একটু ভ্রমন পিপাসু। কোথাও গেলে যানবাহনে চড়া অবস্থায় আমার দৃষ্টি থাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে। মনকে হারিয়ে ফেলি অনেক ক্ষেত্রেই। মূলত এতো রূপ মাধুরীই মনকে মন ভুলানোর দেশে নিয়ে যায়। প্রায়শই রামকৃষ্ণ মিশনের একটি শিক্ষা কার্যক্রম অথবা শীতবস্ত্র বিতরণ উপলক্ষে মেঘালয় রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা হাজংদের নিকট যেতে হয়। পাহাড়ি সবুজের নৈসর্গিক, মনোরম পরিবেশ এবং ঐ স¤প্রদায়ের মানুষদের সহজ-সরল জীবনাচরণ মনকে øিগ্ধতায় প্রশান্তি এনে দেয়। প্রকৃতির নীরবতা এবং প্রশান্ত মনের বন্ধনে। আদিতে মৃত্তিকা তৈরী হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সে মৃত্তিকা প্রাণের অবস্থানের উপযোগী হয়েছে। তারপরেই জীব-জন্তু, গাছপালার অবির্ভাব। পরে মানব গোষ্ঠী। এ মাটিই মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জীবকে রক্ষা করে চলেছে। তাই বিখ্যাত ব্যক্তিগণ মাটিকে মাতৃভূমিকে জননী বলে মর্যাদা দান করেছেন।
উপরোক্ত বিষয়গুলো অনুভব বা অনুভূতির ব্যাপার। সকলের অনুভব বা অনুভূতি এক নয়। যার ভিতর শক্তির উন্মেষ বেশি এবং এ ভাবনায় ভাবিত হয়, সে-ই এগুলোর অধিকারী। তাঁদের ভিতর দিয়েই মানুষ, জগত, জীবনের গূঢ়তম রহস্যের বিষয় উন্মোচিত হয়ে লিখনীর মাধ্যমে সাহিত্যে রূপ লাভ করে। পরে অন্যে তা পাঠ করে আনন্দ পায়।
সৃষ্টির আধার মা, মাটি। এরা যদি ধারণ না করে, তাহলে সৃষ্টির অস্তিত্ব বলতে কিছু থাকে না। এ দুটো পরিপূরক। তাই মা, মাটি এতো গৌরব গাথা পূর্ণ। অতি মায়া-মমতা, অতি প্রেম-ভালোবাসার ভিতর দিয়ে জগতের সৃষ্টি। কয়েক দিন পূর্বে ছুটির দিনে পারিবারিক ভ্রমন বিলাসে গিয়েছিলাম মেঘালয়ের পাহাড় পাদদেশে বাংলা সীমান্তে। আমার বঙ্গভূমির গাছ-পালা, নদী-নালা, পশু-পাথি এবং ওপার দেশের সুউচ্চ পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সকল ভেদ রেখাকে যেন চির বিদায় দিয়েছিল। মনে হয়েছিল আমরা সবাই এক, সমস্ত পৃথিবী যেন মাতৃরূপা। আমরা তারই কোলে। সবাই মনের সুখে ঘুরতে লাগলাম। পরিবারের সদস্যরা ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের গন্তব্য স্থলটি ছিল পাতলাবন। নিজ উপজেলার সীমান্ত। সেখানে আদিবাসী গারো মানুষদের বাস। তাদের সঙ্গে কথাও হলো। কত সরল জীবন যাপন। নয়ন ভরা সৌন্দর্য অবলোকনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথা দিয়ে চলে গেল। দুপুরে খাবারের আইটেম ছিল পোলাও, মাংস, চাটনী। খুব পরিতৃপ্তিতে ভোজন সম্পন্ন হয়েছিল সেদিন। একটু বিশ্রামের পর আবার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে আসল। বৈকালিক আয়োজন মুড়ি-চানাচুর। সবাই চক্রাকারে বসে আনন্দ সহকারে সেগুলো খাওয়া হলো। বিকাল চারটার দিকে নিজ আবাসনে ফেরা। স্বাধীন, সার্বভৌম আমাদের মাতৃভূমি। নতুবা মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় এভাবে ভ্রমনের পরমানন্দটুকু উপভোগ করা সম্ভব হতো না। নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে থাকাই হতো ললাটের লিখন। এ দেশের আউল-বাউল, মালি-মাল­ার, গাওয়া ভাটিয়ালি গান শুনার সুযোগ হতো না।
পরিশেষে, স্বদেশের হিতে নেই যার মন, কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন। স্বদেশ নিয়ে গর্ব করা, স্বদেশ নিয়ে ভাবা পবিত্র কর্ম। সুনাগরিক তৈরীতে স্বদেশ ভাবনা একটি মুখ্য উপাদান। কোন দেশের প্রতিটি মানুষ প্রকৃত দেশ প্রেমিক হলে প্রভুত উন্নতি করা সম্ভব। যেমন একাত্তরে একটি বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলাম আমরা। তা সম্ভব হয়েছিল শুধু দেশ প্রেমের কারণে। আমার এক আত্মীয় স্থায়ী প্রবাসী জীবনে চলে যাবার সময় এক টুকরো জন্মভূমির মাটি সঙ্গে নিয়েছিল অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে।