ইসলামের আবিধানিক অর্থ আনুগত্য, আত্মসমর্পণ, নিঃশর্ত হুকুম পালন। ইসলামের পারিভাষিক অর্থ হলো : ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের বিধান। ইসলাম মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত জীবন যাপন পদ্ধতি। ইসলাম মানুষের সামগ্রিক জীবনের শান্তি, কল্যাণ ও সাফল্যের পথ।
ইসলাম মূলত : একটি দীর্ঘ ও একটি জীবনাদর্শ। ইসলামের মূল দৃষ্টিভঙ্গি হলো : তাওহিদী ঈমান; এক আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব; ‘সৃষ্টি যার বিধান তাঁর’, পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন ও জীবনাদর্শ ও রাসূল সা:-এর নেতৃত্ব ও মডেলের অনুসরণ; পার্থিব সাফল্য ও পারলৌকিক মুক্তি (সাফল্য); দ্বীন ও শরিয়ত; সৎকাজে পুরস্কার এবং অসৎ কাজে শাস্তির বিধান।
মূলত: ইসলাম একটি দ্বীন ও একটি জীবনব্যবস্থা। মহান আল্লাহ বলেন : ‘এবং আমি তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম ইসলামকে দ্বীন হিসেবে।’ (সূরা মায়িদা :৩)
আল কুরআনে দ্বীন শব্দটি ছয়টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে : (১) দ্বীন মানে প্রতিদান : ‘প্রতিদান দিবসের মালিক’ (সূরা ফাতিহা : ১-৪)। ‘তুমি কি তাকে দেখেছো, যে প্রতিদান (দিবসকে) অস্বীকার করে?’ (সূরা মাউন : ১)। (২) দ্বীন মানে আইন : ‘আল্লাহর আইন কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের দু’জনের প্রতি যেনো তোমাদের দয়া না হয়।’ (সূরা নূর :২)
(৩) দ্বীন মানে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা : ‘(ফেরাউন বললো) আমি আশঙ্কা করছি সে (মূসা) তোমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পাল্টে দেবে অথবা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।’ (সূরা মুমিন :২৬)। (৪) দ্বীন মানে ধর্ম ও নৈতিকতা; (৫) দ্বীন মানে আনুগত্য এবং (৬) দ্বীন মানে জীবন যাপন ব্যবস্থা। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম (সূরা আল ইমরান :১৯) ‘আজ আমি পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের জন্য তোমাদের জীবনব্যবস্থা (সূরা আল মায়িদা : ৫:৩)। আল কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী ইসলাম একটি জীবন ব্যবস্থা ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।
এবার দেখা যাক কোন জীবনব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ বলা যায় এবং কখন? পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার শর্তাবলি হলো : তাতে স্রষ্টার পরিচয় এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত ও সন্তোষজনক বক্তব্য থাকতে হবে। তাতে অদৃশ্য বস্তুগুলো সম্বন্ধে জবাব থাকবে হবে। মানুষের মৃত্যুর পর কী হবে, যে বিষয়ের সঠিক, যুক্তিসঙ্গত ও সন্তোষজনক বক্তব্য থাকতে হবে। সেটি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং গোপন এবং প্রকাশ্য সর্বজান্তা ও সর্বজ্ঞানীর প্রদত্ত হতে হবে। তাতে মানব জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা থাকতে হবে। তাতে মানব জীবনের সাফল্যের সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারিত থাকতে হবে এবং তা মানুষের মানসিক প্রশান্তির কারণ হতে হবে। তাতে মানব জীবনে উদ্ভূত সব সমস্যা সমাধানের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা ও মূলনীতি থাকতে হবে। সমাজ ‘সৃষ্টি যার বিধান তাঁর’ এই শাশ্বত মূলনীতির ভিত্তিতে হতে হবে। তাতে মানুষের জৈবিক, নৈতিক, আধ্যত্মিক চাহিদা পূরণের বিধি-বিধান থাকতে হবে। জীবনের সব বিভাগ পরিচালনার মূলনীতি ও নির্দেশিকা থাকতে হবে। অর্থাৎ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনি, আন্তর্জাতিকসহ সব বিষয়ের মূলনীতি ও দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। তা সর্বজনীন ও সব মানুষের উপযোগী হতে হবে। তা সর্বকালীন উপযোগী হতে হবে। তা অনুশীলন ও অনুসরণ করার ও বাস্তবায়ন করার উপযোগিতার নমুনা থাকতে হবে। তাতে যুগ সমস্যার সমাধানের উপযোগী নীতিমালা থাকবে। তাতে সততা, ন্যায়নীতি, পুণ্যকর্ম, পরোপকার ও ধার্মিকতার জন্য পুরস্কার লাভের নিশ্চিত ব্যবস্থা থাকবে। তাতে অন্যায়, অপরাধ ও দুষ্কর্ম, পাপাচার ও জুলুমের জন্য উপযুক্ত শাস্তি ও দণ্ডের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেটির একজন সার্বভৌম এবং সর্বশক্তিমান অর্থরিটি থাকবে। তার সম্পূর্ণ অবিকৃত ও শাশ্বত জ্ঞানের উৎস থাকতে হবে।
পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার এ সব শর্তাবলী একমাত্র ইসলামেই রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। বিশ্বের সব ধর্ম ও মতবাদকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ওই মানদণ্ডে প্রত্যেকটি ধর্ম ও মতবাদে কোনো না কোনো অভাব রয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে : ‘আজ আমি পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন ব্যবস্থা। তোমাদের ওপর পূর্ণ করে দিলাম আমার নিয়ামত (আল-কুরআন) এবং তোমাদের জীবনব্যবস্থা মনোনীত করলাম ইসলামকে। (সূর আল মায়িদা : ৫:৩)
কোনো এক বোধসম্পন্ন ব্যক্তি নির্মোহভাবে পাক কুরআন ও হাদিসসমূহ পঠিত বিশ্লেষণ করে দেখলে, অবশ্যই দেখবেন একমাত্র ইসলামেই রয়েছে : বিশ্বাসগত পূর্ণতা। অদৃশ্য বিষয় সমূহের সন্তোষজনক জবাব; জীবনের অখণ্ডতার ধারণা (ইহকালীন ও পরকালীন)। শাশ্বত নৈতিক দৃষ্টিকোণ, বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবনের পবিত্র মূলনীতি; সামাজিক সুবিচার ও পারস্পরিক সুসম্পর্কের মূলনীতি; সামগ্রিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক মূলনীতি; অর্থনৈতিক পূর্ণাঙ্গ ও সুষম নীতিমালা; আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতিমালা, চিরন্তন হালাল ও হারামের বিবরণ, উত্তরাধিকার বিধান; আইন ও বিচার বিধান; সমর নীতি, সত্য ও বাস্তব মানব ইতিহাস; সর্বপ্রকার বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্ব; মানুষের মুক্তি ও সাফল্যের পথ নির্দেশ; উদারনীতি এবং চিন্তা গবেষণা ও ইজতিহাদ করার অবকাশ; উন্নয়নের নীতিমালা। এতে দেখতে পাওয়া যায় ইসলামের বিধানগুলো সর্বজনীন ও সর্বকালীন; ইসলামেই রয়েছে যুগ জিজ্ঞাসার সমাধান; ইসলামেই রয়েছে এক অদ্বিতীয় সার্বভৌম আল্লাহতে বিশ্বাস। ইসলামী জীবন ব্যবস্থায়ই রয়েছে শাশ্বত মডেল- মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সা:। এসব কষ্টিপাথরের বিশ্লেষণে দেখা যাবে ইসলামই রয়েছে নির্ভুল, শাশ্বত ও অবিকৃত সোর্স অব নলেজ অর্থাৎ আল কুরআন ও সুন্নাহ।
বর্তমান বিশ্বে যত ধর্মই প্রচলিত আছে তার কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা নয়।
ইসলাম ছাড়া সব ধর্মই কেবল কতিপয় নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উপদেশই দিয়ে থাকে। মানব জীবনের বিশাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক, বৈজ্ঞানিক আইন ও বিচার বিভাগীয়, কৃষি ও শিল্পনীতি সম্পর্কীয় কোনো বিধানেই সেগুলোতে পাওয়া যায় না। অপরদিকে বিশ্বে যে ধর্মহীন আধুনিক মতবাদ প্রচলিত আছে সেগুলোর সবগুলোরই ভিত্তি স্রষ্টা ও ধর্মবিবর্জিত বস্তুবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তা তার প্রত্যেকেরই কোনো একটি খণ্ডিত দার্শনিক চিন্তা ভিত্তিক। মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনকে নিয়ে সেগুলোর কোনো বক্তব্য নেই। সে হিসেবে বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত বৌদ্ধ ধর্ম, ইহুদীবাদ, খ্রিষ্টবাদ কিংবা অন্যান্য ধর্ম, এ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, হেগেলীয় ইতিহাস দর্শন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ, মার্কসীয় কম্যুনিজম, সোস্যালিজম, ফ্রয়েডীয় যৌনবাদ এবং অন্যান্য দার্শনিক মতবাদ কোনোটাই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তো নেই, সাধারণ জীবনব্যবস্থা হওয়ারই যোগ্য নয়। মানুষের জীবনব্যবস্থাও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হওয়ার শর্ত ও বৈশিষ্ট্য এসবগুলো মতাবাদেই অনুপস্থিত। ফলে সব মতবাদ কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
অবশিষ্ট থাকে শুধু ইসলাম। মূলত : একমাত্র ইসলামই মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের জীবনব্যবস্থা এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হওয়ার সব শর্ত ও বৈশিষ্ট্য কেবল ইসলামেই রয়েছে। তাই দীর্ঘ ১৪০০ বছর ধরে কুরআন-সুন্নাহ অবিকৃত রয়েছে। ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিশাল ভূখণ্ড ও বিশাল জনগোষ্ঠী ইসলামকে তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং আজো গ্রহণ করছে।
জীবনের প্রতিটি বিভাগের জন্য ইসলাম প্রদত্ত মূলনীতি আজো ঠিক সে রকমই অভ্রান্ত এবং অনন্য, যেমনটা ছিল এর প্রথম যুগে। ইসলামের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে মুসলিম জাতির অধঃপতনের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিশ্বের যে কোনো ধর্ম, বর্ণ ও জাতি গোষ্ঠীর লোকেরাই ইসলামকে তাদের জীবন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা অবশ্যই বিশ্বের সেরা, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বসুন্দর মানব দলে পরিণত হবে। ইসলামের প্রথম দিকের হাজার বছরের ইতিহাস এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।