জুতা নিয়ে কিছু কথা

এবাদত আলী


জুতা নিয়ে জুতসই লেখালেখি যেমন কঠিন কাজ তেমনি জুতার প্রচলন সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস উদ্ধার করাও অনুরূপ কঠিন বিষয়। তবে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘জুতা আবিষ্কার’ যারা পাঠ করেছেন, তাঁদেরকে স্বাক্ষী রেখে যদি জুতার প্রচলনের সময়কাল নিদ্ধারণ করা যায় তাহলে বোধ করি মন্দ হয়না।
জুতা শব্দের আভিধানিক অর্থ চর্ম পাদুকা বা জুতা। পদব্রজে যারা চলাফেরা বা ভ্রমন করে তাদেরকে বলা হয় পাদবিক। এই পাদবিক শব্দ থেকেই পাদুকা শব্দের উৎপত্তি কিনা কে জানে। আমাদের দেশে চর্ম পাদুকা জুতো বা জুতা হিসাবে বেশি প্রচলিত। পথ চলার সময় পায়ে জুতা ব্যবহারের উপকরিতা সম্পর্কে বোধ করি আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন হবেনা। মানুষের চলার পথে নিরব সঙ্গি হিসাবে চলে এক জোড়া জড় পদার্থ জুতা। মানুষের সফর সঙ্গি হিসাবে তাই জুতার জুড়ি মেলা ভার।
একটি তথ্য হতে জানা যায় যে, একজন কর্মব্যস্ত মানুষ প্রতি দিন প্রায় ৯ হাজার কদম হাটা হাটি করে থাকে। এ ভাবে একজন মানুষ তার সারা জীবনে গড়ে প্রায় সাড়ে তিন বার পৃথিবী প্রদক্ষিন করার মত হেঁটে বেড়ায়। তাই জুতা বিশ্ব ভ্রমনের ও সাথি। মানব সভ্যতায় জুতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য বেশ উজ্জল। মানুষের রুচি, পছন্দ এবং সৌন্দর্য বোধে জুতার অবদান অনস্বীকার্য।
আগেকার রাজা বাদশাহ গণের জুতা ব্যবহার সম্পর্কে বহুবিধ কাহিনী প্রচলিত আছে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে যাবার সময় জুতার কারনেই নাকি ভগবান গোলায় মীরজাফরের গুপ্তচরদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট মার্কোস কে উৎখাত করে জনগন যখন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল করে নেয়, তখন প্রেসিডেন্ট পতœী ইমেলদার ব্যবহৃত প্রায় ৩ হাজার জোড়া জুতা দেখতে পেয়েছিলো।
মানুষের কল্যানে জুতার প্রচলন সূদুর অতীত থেকে শুরু হয়। তখন তার ডিজাইন ও ছিলো ভিন্ন ধরনের। প্রায় ৫শ বছর বেশি সময় আগে ইউরোপের মানুষ বেজায় লম্বা জুতা পরতে পছন্দ করতো। তখনকার জুতার ডগা ছিলো বেশ সুচালো। আবার কিছু কিছু জুতার ডগা এতই লম্বা ছিলো যে জুতা ওয়ালাকে সূচালো লম্বা ডগা দুটো হাটুর সাথে বেধে রাখতে হতো। আঠারো শতকের জুতা ছিলো এক ঢালা। কো›্ টা ডান পায়ের আর কোন্টা বাম পায়ের তা নির্ধারিত ছিলোনা। যে কোন পায়ে যে কোন জুতা অনায়াসেই ব্যবহার করা যেতো। উনিশ শতকের জুতা গুলোর চামড়া ছিলো বেজায় রকমের শক্ত। যে জুতা যত বেশি বনেদি, সে জুতা পরার যাতনা ও ছিলো তত বেশি। আর সে কারনেই ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান নতুন জুতা পরতে দারুন ভয় পেতেন। নতুন জুতা এলে আগে চাকর বাকরদের দিয়ে পরিয়ে সাইজ করে নিতেন। আর ফোস্কা- টোস্কা যা কিছু তা ঐ চাকর বাকর দের উপর দিয়েই যেতো। তার পর নরম হয়ে আসা জুতা তিনি আরাম করে পরতেন।
শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের “নতুনদা”গল্পে কুকুরের ভয়ে ভীতু নতুনদার মহামূল্যবান পাম্প স্যুর কথা পাঠকের মনে আজো হাসির খোরাক জোগায়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কৌতুককার ভানু বন্দোপাধ্যায় একবার এক জোড়া নতুন জুতা বা চপ্পল পায়ে তার গুরুদেবের সাথে আলাপের এক ফাঁকে গুরুদেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন ভানু তোমার চপ্পল জোড়া তো খুবই সুন্দর, নতুন কিনেছো বুঝি। ভানু বন্দোপাধ্যায় গুরুদেবের মনোভাব বুঝতে পেরে বল্লেন তা গুরুদেব যদি কৃপা করেন তয় জুতা জোড়া আপনেরে দিয়ে দেই। গুরুদেব তখন বল্লেন তা এখান থেকে খালি পায়ে যাবে রাস্তায় লোকজন যদি জিজ্ঞাসা করে তাহলে কি বলবে। তখন ভানু উত্তর দিলেন- গুরুদেব এ নিয়ে আপনি মোটেই ভাববেন না, কেউ জিগালে বলবো কুত্তায় লইয়া গেছে।
জুতা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অপরিহার্য বস্তু। আগেকার রাজা-বাদশা, উজির নাজির ও জমিদারদের বনেদির মাপকাঠিই ছিলো জুতা। বর্তমান যুগেও আভিজাত্য রক্ষায় জুতার জুড়ি নেই। তাই দেশে বিদেশে রয়েছে জুতা তৈরির বহু সংখ্যক কারখানা। আর এই সকল কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে লাখ লাখ মানুষ। জুতার কালি, ব্রাশ, ক্রিম ইত্যাদির জন্য ও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নামি দামী শিল্প। এ ক্ষেত্রে জুতার ফিতা এবং জুতা পরার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত শিঙের বা ধাতুর বাঁকা পাত দ্বারা নির্মিত স্যুহর্ন ও ফেলনা নয়। শহর উপশহর, বন্দর, হাট-বাজার, লঞ্চ-ফেরিঘাট, রেল ষ্টেশন ইত্যাদি স্থানে প্রতিনিয়তই এক শ্রেনীর মুচি বা চর্মকার জুতা মেরামত ও জুতা পালিশের জন্য সদা ব্যস্ত। জুতার বদৌলতে তারা যেমন দু পয়সা রোজগার করে অনুরূপ তাদের কল্যাণে পথচারিদের ও মহা উপকার হয়ে থাকে।
আমাদের সমাজ জীবনে যে ব্যক্তি ছোট বড় প্রায় সব ধরনের কাজ জানে তাকে বলা হয় জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ তার রপ্ত করা আছে। জুতা পেটা করা, জুতানো বা জুতা মারা এই কম্মটি আমাদের সমাজ জীবনে নিদারুন ঘৃনার ও অপমান জনিত। তদ্রুপ অধিক অপমানের পর জামাই আদর করাকে বলে জুতা মেরে গরু দান। অনেকেই অর্থের বিনিময়ে অবৈধ ভাবে কাজ বাগিয়ে নিয়ে বলে চাঁদির জুতা মেরে কাজ আদায় করেছি। জুতার ভিতরের একটি পাতলা চামড়াকে বলা হয় জুতার সুকতলি। এ সমাজে যারা প্রভাব প্রতিপত্তিশালী তাদের মাঝে কেউ কেউ অতি দুর্বল লোকদেরকে জুতার সুকতলির মত মনে করে থাকে।
আমাদের দেশের গ্র্রাম অঞ্চলে এখনো কেউ গর্হিত কোন কাজ করলে শালিশী বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শাস্তিস্বরূপ তার গলায় ছেঁড়া জুতার মালা পরিয়ে গ্রাম বা মহল্লা প্রদক্ষিণ করানো হয়।
রাজনৈতিক প্রতি পক্ষের বিরুদ্ধে মিছিল করে অনেক সময় মিছিলকারিরা বলে থাকে অমুকের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে। তবে আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিই বুশ এর গাল বরাবর সত্যি সত্যিই দু পাটি জুতা ছুঁড়ে মেরে বিশ্ব ব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টি করেন এক সাংবাদিক যুবক। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝা মাঝি সময়ে (১৪-১২-২০০৮ ) বাগদাদে এক সংবাদ সম্মেলনে মুনতাজার জেইদী নামক এক সাংবাদিক বুশকে লক্ষ করে তার দু পাটি জুতা ছুঁড়ে মারেন। এ ঘটনা নিয়ে বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রচুর লেখা লেখি হয়। টেলিভিশনে বার বার দেখানো হয় সে দৃশ্য। ইউটিউবে এ দৃশ্য দেখার জন্য লাখ লাখ মানুষ ইন্টারনেটে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সৌদি আরবের এক ব্যক্তি এক কোটি ডলার দিয়ে মুনতাজারের সেই জুতা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে।
অতি সম্প্রতি রংপুরের পীরগঞ্জে মসজিদে জমু’ার নামাজ শেষে জুতা বদলকে কেন্দ্র করে সাংঘাতিক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে মাথা ফাটাফারি মত অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় অনেককেই হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
এক জোড়া জুতার জন্য ২০১৪সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংযুক্ত আরব আমীরাতের শারজাহ শহরে দুজন প্রবাসি বাংলাদেশি নিহত হয়েছিলেন।পুলিশ বলেছে একজন জুতা পরলে অন্যজন তা নিজের বলে দাবি করে। তাদের মধ্যে বাদনুবাদ শুরু হলে একজন রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে অন্যজনকে আঘাত করে। সে ব্যক্তি ছুড়ি কেড়ে নিয়ে তার বুকে বসিয়ে দিলে দুজনেরই মৃত্যু ঘটে।
পাদুকা বা জুতা চুরির জন্য এক শ্রেণীর চোর মসজিদ, দরগাহ, গোরস্থান, ঈদগাহ, মন্দির, গীর্জা সহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আচার অনুষ্ঠানে ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা জুতা চুরি করে চম্মট দেয়। তবে এ দেশে চোরদের মাঝে সব চেয়ে নিকৃষ্ট চোর হলো জুতাচোর।
শিক্ষিত বেকার যুবকগণ চাকুরি পাবার আশায় এ অফিস ও অফিস, এ প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে প্রতি নিয়ত ঘোরা ঘুরি করে জুতার তলা ক্ষয় করে থাকে। তবে হাই হিল ওয়ালা জুতা বেঁটে খাটো মেয়েদের উচ্চতা বাড়িয়ে বিয়ে সাদির ব্যাপারে যথেষ্ট উপকারে আসে। পল্লী অঞ্চলের কিছু সংখ্যক মায়েরা চোখ লাগা ও জিন-ভুতের আছর থেকে নিজ শিশুকে সহি সালামতে রাখার জন্য শিশু পুত্র-কন্যার গলায় ছেঁড়া জুতার চাকতি বানিয়ে সুতা দ্বারা গলায় বেধে রাখে।
‘শেষ মুঘল স¤্রাট বাহাদুরশাহ জাফরের বংশধর প্রিন্স হাবিবুদ্দিন তুসি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাবরি মসজিদের জায়গায় অযোধ্যায় বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দিরই দেখতে চান বাবরের এই বংশধর। রাম ভক্তদের পক্ষ নিয়ে তিনি তাদের এই বিশ্বাসকে মান্যতা দিয়ে ঐ ঘটনার জন্য পুরো পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষমাও প্রার্থণা করেন। এর জন্য প্রতিক হিসেবে নিজের মাথায় রাম লালার চরণ পাদুকা বা জুতাও ধারণ করেন।’ (সুত্র: কালের কন্ঠ অনলাইন, ১৯ আগস্ট-২০১৯)।
কোন কোন ক্ষেত্রে জুতার মান ইজ্জত অত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। বিশেষ করে পীর মুরশিদের জুতা তার মুরিদানের নিকট অমুল্যধনের শামিল।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী, সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।