সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে আছে মশার ওষুধ আমদানি। দুটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে মশার ওষুধ আনা হয়। এর মধ্যে একটি বিতর্কিত পাকিস্তানি কোম্পানি। পাকিস্তানি কোম্পানির কাছ থেকে ওষুধ নেওয়া নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, ঐ কোম্পানির মালিক জামায়াত নেতা। তাদের দেওয়া ওষুধ অকার্যকর। দীর্ঘদিন ধরে ওষুধের নামে ‘পানি’ ছিটিয়ে আসছে দুই সিটি করপোরেশন। ওষুধ ক্রয়ের অনুমোদনের আগে কীটনাশক বিশেষজ্ঞের লাইসেন্স পেতে হয়।
এছাড়া বিশেষজ্ঞ কমিটি, ক্রয় কমিটি ও আইইডিসিআরের অনুমোদনের বিষয়টিও আছে। সবকিছুই যেন সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। এমন নানা জটিলতা পার করে যেহেতু ওষুধ আমদনি করতে হয়, তাই এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর ওষুধ আনার ক্ষেত্রে অনেকটা অনিশ্চিয়তা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ওষুধ কেনাসৌদি আরবে ১১ আগস্ট পবিত্র ঈদুল আজহার আগে আইইডিসিআর প্রথমে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয়। এরপর আইসিডিডিআর,বি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কীটতত্ত্ব বিভাগের রিপোর্ট পাওয়ার পর বিশেষজ্ঞ কমিটি ওষুধ ক্রয়ের অনুমোদন দিয়ে থাকে। নতুন কোনো কোম্পানিকে এই ধাপগুলো পার করে ওষুধ আমদানির সুযোগ দেয় না ঐ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে মন্ত্রণালয় ও বিশেষ কমিটির অনেক কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। আইইডিসিআর এরই মধ্যে বলেছে, রিপোর্ট দিতে সময় লাগবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ‘সময় নিলে হবে না। এক দিনে সবাইকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বর্তমানে দুটি প্রতিষ্ঠান দুই সিটি ভাগ করে ওষুধ বিক্রি করে। উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা নোকন নামের একটি কৃষি ও কীটনাশক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ওষুধ কিনছে। আর লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের মাধ্যমে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ওষুধ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) মশক নিধনের ওষুধ পরীক্ষা করে বলেছে, এগুলো অকার্যকর। একই ওষুধ পরীক্ষা করে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখাও (সিডিসি) বলেছে একই কথা।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে ৫ অক্টোবর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশে ওষুধ আমদানির বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। পেস্টিসাইড কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (পিটাক) সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কৃষিকাজে ব্যবহার্য ও জনস্বাস্থ্যে ব্যবহার্য বালাইনাশক দ্রব্যাদির নতুন রেজিস্ট্রেশনের জন্য কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এখানে প্রোডাক্টের তথ্য-উপাত্ত, কারিগরি মূল্যায়ন, মিশ্রণের পরিমাণ এবং মূল্যায়ন, ভ্যাট সার্টিফিকেট, কোম্পানি মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংকের সচ্ছলতা সনদ, এনওসি, প্রোডাক্ট নমুনা মূল্যায়ন এবং বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) নতুন নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তিকে বিধিমালা হিসেবে প্রচার করে সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে দেশের কীটনাশক আমদানি খাতকে। তিন-চারটি কোম্পানির হাতে রয়েছে এই আমদানির চাবিকাঠি। নতুন কোনো কোম্পানিকে এই ধাপগুলো পার করে ওষুধ আমদানির সুযোগ দেয় না ঐ সিন্ডিকেট। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় এসব ওষুধ অকার্যকর প্রমাণিত হলেও তাদের কাছ থেকেই ওষুধ কিনতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, লিমিট অ্যাগ্রো প্রতিষ্ঠানটি গত ১৫ বছর ধরে ওষুধ সরবরাহ করত। অনিয়ম পাওয়ায় তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে বাতিল করা হয়। আর নোকন নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এরা গত এক বছর ধরে ওষুধ দিচ্ছে, তবে তারা পাকিস্তানি কোম্পানি কি না তা আমার জানা নেই। কমিটির মাধ্যমে নোকনকে নির্বাচিত করা হয়েছে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন জানান, অ্যাডিস মশা নির্মূলের কাজ সঠিকভাবে করে যাচ্ছি। তবে আমাদের জনবলের অভাব রয়েছে। কলকাতায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ২৫ জন কর্মী থাকলেও আমাদের রয়েছে মাত্র তিন জন। অথচ জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ওয়ার্ডে জনবল দরকার ৫০ জন। ৯ বছর ধরে জনবল বাড়ানোর জন্য আবেদন করে এলেও মন্ত্রণালয় অনুমতি দেয়নি। সময় এসেছে সব বিষয় জনগণের সামনে উপস্থাপন করার।
মাঠ পর্যায়ের মশক নিধন কর্মীরা জানান, দুই বছর ধরে ওষুধে কাজ হয় না। অকার্যকর ওষুধ থাকায় আমরা কাজ করি না। অকার্যকর ওষুধ ছিটানোর কারণে মশার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।
আক্রান্ত আরো ১ হাজার ৭১২ জন :ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন আরো ১ হাজার ৭১২ জন। মারা গেছেন আরো ছয় জন। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৬০ জন জন মারা গেলেন। এত মানুষের মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে? অন্যদিকে আর কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কি না, সেটা পরীক্ষার জন্য ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটের (রি-এজেন্ট) প্রয়োজন হয়। এরই মধ্যে রি-এজেন্ট সংকট দেখা দিয়েছে। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে সংকট ঘনীভূত হতে পারে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এনএস-১ ও সিবিসি পরীক্ষার জন্য রি-এজেন্ট প্রয়োজন হয়। রি-এজেন্টের সংকট দেখা দিলে মহাবিপর্যয় দেখা দেবে। ভুল চিকিত্সার আশঙ্কা থাকবে। এছাড়া অনেকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে। তাই এ ব্যাপারে সঠিকভাবে মনিটরিং প্রয়োজন। কেউ মনিটরিং করছে না। এটা দেখারও কেউ নেই।
এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান জানান, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সাতটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ কোটি ৬১ লাখ পিস ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট আমদানির নিমিত্তে এনওসি/পূর্বানুমোদন প্রদান করেছে। এরই মধ্যে উক্ত ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিটের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দেশে পৌঁছেছে এবং বিভিন্ন হাসপাতাল/ক্লিনিকে সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ঢাকায় : এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরামর্শ দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কীটতত্ত্ববিদ ডা. নাগপাল ঢাকায় এসেছেন। এছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিশিষ্ট চিকিত্সকদের নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ে যিনি কাজ করেছেন, তার নাম অনীক ঘোষ। আমি তাকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমাকে আমন্ত্রণপত্র পাঠান। আমি বুধবার রাত ১০টায় আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছি। আগামী রবিবার অনীক ঘোষ বাংলাদেশে আসবেন বলে কথা দিয়েছেন।’
এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ২০ হাজার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, সারাদেশে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরো ১ হাজার ৭১২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ১ হাজার ১৫০ জনই রাজধানীতে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৫১৩ জনে। রাজধানীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাইরেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে ৩ হাজার ৪৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিত্সা নিচ্ছে। ইত্তেফাক