রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধে অমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজশাহীর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা ও জজ এনায়েত কবীর সরকারের আদালতে সাঈদীসহ মোট ১০৭ জন আসামির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গঠন হয়। এর আগে আদালতে অভিযোগের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ দিন মামলার জামিনে থাকা ৬০ জন আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। শুনানির জন্য বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতের সামনে আনা হয়।
সাঈদী হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য হুইল চেয়ার তুলে ধরে সাঈদে একটি ভবনের দোতলায় আদালতে নিয়ে যান। আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাবিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন মারা যান। এ নিয়ে রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম অপু নগরীর মতিহার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীসহ মোট ১১০ জনকে আসামি করা হয়। এরপর ২০১২ সালের জুলাই মাসে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। মামলাটি তখন মহানগর দায়রা ও জজ আদালতে চলছিল। দেড় বছর আগে মামলাটি অতিরিক্ত মহানগর দায়রা ও জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর অভিযোগপত্র দাখিলের ৯ বছর পর এ মামলার অভিযোগ গঠন হলো। ফলে এখন থেকে মামলার বিচার কার্যক্রমও শুরু হলো। অভিযোগের শুনানির সময় ৫৯ জন আসামি কাঠগড়ায় ছিলেন। আর দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ছিলেন কাঠগড়ার বাইরে, আদালতের ভেতরেই। তিনি হুইল চেয়ারেই বসে ছিলেন। বয়স বিবেচনায় তাকে কাঠগড়ার বাইরে রাখা হয়। পরে শুনানি ও অভিযোগ গঠন শেষে বেলা ১২টার দিকে তাকে আদালত থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সিরাজী শওকত সালেহীন জানান, অভিযোগের শুনানির সময় আসামিদের কাছে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।
তখন দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী বলেছেন, হত্যাকা-ের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেনও না। তাই তিনি আদালতের কাছে সুষ্ঠু বিচার প্রার্থনা করেন। তিনি আরও জানান, মামলার মোট ১১০ জন আসামির মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে ইতিমধ্যে মৃত্যুদ- পেয়েছেন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মো. মুজাহিদের। এছাড়া মো. শাহীন নামে আরও এক আসামি মারা গেছেন। তাই এই তিনজনকে বাদ দিয়ে ১০৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হলো। মামলার অভিযোগপত্রের বরাত দিয়ে আইনজীবী শওকত সালেহীন বলেন, ফারুক হত্যাকা-ের দুই দিন আগে ৭ ফেব্রুয়ারি মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ও রাজশাহী জামায়াতের শীর্ষ নেতারা শহরে ছাত্রশিবিরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানেই নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি খুনের নির্দেশনা দেন। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রস্তুতি নেয় ছাত্রশিবির। ৯ ফেব্রুয়ারি তারা সংঘর্ষ বাধিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুককে হত্যা করে। তাই দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীসহ সব আসামির বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এছাড়া শুধু সাঈদীর বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেয়ার ১০৯ ধারায় আরও একটি অভিযোগ আনা হয়েছে। প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। অভিযোগের শুনানির সময় আসামিপক্ষে অন্তত ১০ জন আইনজীবী ছিলেন। তাদের নেতৃত্ব দেন আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। আদালতে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর দুই ছেলেও উপস্থিত ছিলেন। আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আরও জানান, অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। মামলার আগামী ধার্য্য দিন থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে। মামলাটিতে প্রায় শতাধিক সাক্ষী রয়েছেন বলেও জানান তিনি। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুন জানান, এই মামলার অভিযোগ গঠনের জন্য গত শনিবার গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে তাদের কারাগারে আনা হয়। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে আবার কাশিমপুরে পাঠানো হবে। এদিকে সাঈদীকে আদালতে তোলাকে কেন্দ্র করে বুধবার থেকেই রাজশাহীর আদালত চত্বরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বৃহস্পতিবার পুরো আদালত চত্বরকেই নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিপুল সংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী ক্রাইসিস রেসপন্স টিমের (সিআরটি) সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সক্রিয় ছিলেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও। আদালত চত্বরের সবগুলো প্রবেশমুখে তল্লাশি ছাড়া কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেওয় হয়নি।