// বাংলাদেশে মসজিদ রয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে অসংখ্য ইতিহাস সমৃদ্ধ মসজিদ রয়েছে। কোনোটির ১৩০০ বছর আগের, আবার কিছু মসজিদের বয়স ২৫০ হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে দারুণ কিছু দৃষ্টান্ত। এমন অসংখ্য মসজিদের মধ্যে মাত্র তিনটি মসজিদের স্বল্প আলোচনা করা হলো এই আয়োজনে —
১৯৭২ সাল। স্বাধীন দেশের সোনাফলা মাটিতে চাষ করতে গেলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক কৃষক। লাঙল দাবাতেই শক্ত কী যেন লাগল। লাঙল আর চলছেই না। বরং যত জোর দেওয়া হলো, একে একে বেরোতে লাগলে আবির রং-এর ইট। আরেকটু দূরে চাষ করতে গিয়েও একই অবস্থা! কপালে চিন্তার ভাঁজ! কী হতে পারে? ফিরে এসে পাড়ার মানুষকে জানালেন। এককান দু’কান করে খবর পেল স্থানীয় প্রশাসন।
খোঁড়া হলো মাটি। বেরিয়ে এলো ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’। তবে প্রথম দিকে এ মসজিদের নাম দারাসবাড়ি ছিল না। আগে এ মসজিদের নাম ছিল ‘ফিরোজপুর মসজিদ’।
এটি বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার ছোট সোনা মসজিদ ও কোতয়ালী দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরে দারাসবাড়ি মসজিদের অবস্থান। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদের রয়েছে বেশ সমৃদ্ধ ইতিহাস।
মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে, বাংলার আদি রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুরে। তখনকার শাসক সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের আদেশে এটি নির্মাণ হয়। তখন এর নাম ছিল ফিরোজপুর মসজিদ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ওই এলাকার শাসক নিযুক্ত হন সুলতান হোসেন শাহ।
মসজিদের অদূরে দারাসবাড়ি নির্মাণ করেন। আরবি দরস অর্থ পাঠ। তাই তত্কালীন শিক্ষাঙ্গনকে বলা হতো দারসবাড়ি বা দারাসবাড়ি। দারাসবাড়ির সুনাম, সুখ্যাতিতে এলাকার নামও পাল্টে যায়। হয় দারাসবাড়ি। এর সঙ্গে পাল্টে যায় মসজিদের নামও। পরিচিত হয় ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’ নামে।
জানা যায়, স্বাধীন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের রাজত্বকালে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে ১ রমজান এখানেই সুবিশাল আবাসিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসাটি পাঠক্রম ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় ছিল একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়তুল্য। এখানেই মুহাম্মদ বিন ইয়াজদান বখশ নামের একজন বুজুর্গ আলিম নিজ হাতে বুখারি শরিফ লিপিবদ্ধ করেন এবং তিনিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন।
মসজিদের অভ্যন্তর দুই অংশে বিভক্ত। এর আয়তন ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি দৈর্য্য ও ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি প্রস্থ। মসজিদের উপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্ন দেখা যায়। মসজিদের পূর্ব পার্শ্বে একটি বারান্দা; যার আয়াতন ১০ ফুট ৭ ইঞ্চি। বারান্দার খিলানে ৭টি পাথরের স্তম্ভের ওপরের ৬টি ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজ এবং মধ্যবর্তীটি গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড়। উত্তর দক্ষিণে ছিল ৩টি করে জানালা।
দারাসবাড়ি মসজিদের বাহির এবং অভ্যন্তর দেয়ালে টেরাকোটা খচিত আকর্ষণীয় কারুকাজ দেখা যায়। পশ্চিমের দেয়ালে পাশাপাশি ৩টি করে ৯টি কারুকার্য খচিত মেহরাব এখনও লক্ষণীয়। মসজিদটির চার পার্শ্বে দেয়াল ও কয়েকটি প্রস্তর স্তম্ভের মূলদেশ ব্যতীত এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এক সময় এখানে অবস্থিত তোগরা অক্ষরে উত্কীর্ণ ইউসুফি শাহী লিপিটি এখন কলকাতা জাদুঘরে রক্ষিত আছে বলে জানা যায়।
লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রাম। দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি ফসলের মাঠ। এখানেই ১৩৭৭ বছর আগে নির্মিত এক মসজিদের খোঁজ মিলেছে! যেটিকে এখন এশিয়ার প্রথম মসজিদও বলা হচ্ছে।
১৯৮৭ সালের কথা কথা। ভয়ঙ্কর জঙ্গলে ঘেরা এক উঁচু স্থান পরিস্কার করতে নেমেছিল গ্রামবাসী। আশপাশের জায়গার তুলনায় ৮-১০ ফুট উঁচু সেই স্থানটি। দিনের বেলায়ও সেখানে ছিল ঘোর অন্ধকার। জঙ্গলটি পরিষ্কার করার সময় কিছু প্রাচীনকালের ইট বেরিয়ে আসে। মাটি ও ইট সরাতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় মসজিদের ভিত।
কথা হলো, এরকম পোড়া মাটির স্থাপত্যতো বাংলাদেশে এর আগেও অনেক পাওয়া গেছে। তাহলে এটার বিশেষত্বটা কোথায়? রহস্যটা হলো, এই মসজিদ কে বা কারা নির্মাণ করলো সেটা নিয়ে। সেইসব পোড়া মাটির ফলক কার্বন ডেট করে প্রত্নতাত্ত্বিকবিদরা নিশ্চিত হয়েছে, এর নির্মাণকাল আনুমানিক ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি বা ৬৯ হিজরিতে। এর মানে এটি এক হাজার ৩৭৭ বছর আগের মসজিদ!
মসজিদের ধ্বংসস্তূপে যে শিলালিপি পাওয়া যায় তাতে সুস্পষ্টভাবে আরবিতে লেখা আছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, হিজরি ৬৯ সাল।’ শিলালিপির সূত্রে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৬৯ হিজরিতে নির্মিত হয়েছে এ মসজিদটি। খননের পর মসজিদের মেহরাব এবং মসজিদসংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও খুতবার মিম্বরও আবিষ্কৃত হয়। এলাকার লোকজন এ মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানো মসজিদ’।
ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন, সাহাবি হজরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) এ অঞ্চল দিয়েই চীনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বর্তমানে চীনের বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে তার নির্মিত মসজিদ ও সমাধি রয়েছে। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিল দাবি করেন, খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পাড় ধরে সিকিম হয়ে চীনের মধ্য দিয়ে আরব ও রোমান বণিকদের বাণিজ্য বহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণ রয়েছে তার কাছে। এ হারানো মসজিদ হতে পারে সাহাবি আবু ওয়াক্কাস (রা.) নির্মাণ করেছেন।
তবে ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের এই মসজিদ নির্মাণ অবাক হওয়ার কিছু নয় কারণ বাংলায় সভ্যতার বিকাশ সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে যা কি-না প্রাচীন রোমান, গ্রিক, পারস্যের সঙ্গে তুলনাযোগ্য। এই মসজিদের নির্মাণের সময় বাংলায় খড়গ বংশের শাসন চলছিল; যারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী।
কিশোরগঞ্জে শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। মসজিদটির ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমত্কার। তিন তলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান একটি মিনার বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। কিন্তু এই মসজিদের সৃষ্টি কীভাবে?
মহাবীর ঈশা খানের অধস্তন পুরুষ দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিলকদর পাগলা দুনিয়াদারি ছেড়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় একাকী জীবনযাপন করতেন। ফলে তিনি মানুষের কাছে ‘পাগলা সাহেব’ বলে পরিচিত ছিলেন। এই আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে স্থিত হন এবং তাকে ঘিরে আশেপাশে অনেক ভক্তকূল সমবেত হন। তার ইবাদত-বন্দেগির জন্য দেওয়ান পরিবারের পক্ষ থেকে পাগলা সাহেবের নিজের পছন্দের স্থান নরসুন্দা নদীর মাঝখানে টিলার উপর একটি টিনের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। ওই ঘরটি পরবর্তীতে ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এমন জনশ্রুতিই সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। অপর জনশ্রুতি অনুসারে, তত্কালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের এক নিঃসন্তান বেগমকে জনগণ ‘পাগলা বিবি’ বলে ডাকত। দেওয়ানবাড়ির এ বেগম নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে ‘পাগলা বিবির মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়।
পাগলা মসজিদটি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কাছে নয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে সব ধর্মাবলম্বীর কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত। এই মসজিদে মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন। নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন। অধিক দান-খয়রাতের কারণে পাগলা মসজিদ ইতিমধ্যেই দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।