করোনা কালের জীবন ধারা–৭


— এবাদত আলী —
লকডাউনের মধ্যে সঙ্গনিরোধ ব্রত পালনে বাইরে বেরুনো নিষেধ। কিন্তু দীর্ঘদিন সেলুনের দোকান বন্ধ থাকায় অনেকেরই চুল-দাড়ি বড় হয়ে বেঢক হতে বসেছে। দেশে যুদ্ধ শুরু হলে এমনটাই হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের দ্বারা দোকান-পাট লুট-তরাজের ভয়ে এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হতে রক্ষা পাবার জন্য সেসময় সারা পুর্ব পাকিস্তানের শহরের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। জীবন রক্ষার তাগিদে তারা শহর ছেড়ে গ্রাম-গঞ্জে পালিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে তৎকালিন সময়ে জেলা শহর এবং মহকুমা শহর ছাড়া আজকালকার মত দেশের বিভিন্ন স্থানে দোকান-পাটসহ সেলুন দোকান ছিলোনা। সেসময় নরসুন্দর বা নাপিতেরা হাটে হাটের দিন উন্মুক্ত স্থানে টুল এবং পিঁড়া নিয়ে বসতে দিয়ে লোকজনের চুল -দাড়ি কাটা বা ক্ষেউরি করতো। মুক্তি বাহিনীকে লোক চক্ষুর আড়ালে থাকতে হতো তাই তাদের জন্য চুল-দাড়ি কাটা সম্ভব হতোনা। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের চুল এতো লম্বা হতো যে, অনেকে আবার তা গিট দিয়ে রাখতো। বর্তমানে করোনভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘরে থাকার কারণে এমনি অবস্থার সৃষ্টি হতে চলেছে।
তবে করোনাভাইরাসের দিক থেকে মুরুব্বি রাষ্ট্র চীনের লোকজনের অবস্থাও তথৈবচ। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সেখানে দুই একটা সেলুন দোকান খোলা রাখা হতো। সামাজিক দুরত্ব বা ব্যক্তি দুরত্ব বজায় রাখতে তারা তিনফুট লম্বা ষ্টিকের সাথে চিরুনি গেঁথে গ্রাহকের চুল দাড়ি ছেঁটে দিয়েছেন। তাদের মুখে এবং খরিদ্দারের উভয়ের মুখেই মাস্ক পরা থাকতো বলে পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে। ভারতের মধ্যপ্রদেশের খারগো গ্রামে লকডাউনের মধ্যে লকডাউন উপেক্ষা করে সেলুনে চুল-দাড়ি কাটতে গিয়ে ৬ জন করোনায় আক্রান্ত হন। পত্রিকান্তরে প্রকাশ ঐগ্রামে মোট করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৬০। তন্মধ্যে মারা গেছে ৬ জন।
পাবান শহরের এক ব্যক্তি করোনা সন্দেহে নমুনা পরীক্ষা করাতে দিয়ে দেদারছে শহরের মধ্যে ঘুরাফেরা করেছেন। দোকানে দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করেছেন। সেলুন দোকান বন্ধ থাকায় এক নরসুন্দরকে নিজ বাসায় ডেকে নিয়ে চুল-দাড়ি কাটার কম্মটিও সমাধা করেছেন। পরীক্ষায় তার করোনা ধরা পড়েছে। তার জন্য পাবনা শহরের মানুষজন আতঙ্কিত। পাবনায় এপর্যন্ত (৩০-০৪-২০২০) করোনা রোগীর সংখ্যা ১০জন।
লকডাউনের মধ্যে রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনে রাতের বেলা শাটার বন্ধ করে সেলুনে চুল-দাড়ি কাটার সময় এসি বিস্ফোরণে সেলুন মালিকসহ তিনজন আহত হয়েছেন।
এদিকে শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রি শেখ হাসিনা বলে আসছেন কারোনায় খাদ্যের কোন অভাব হবেনা। তিনি ৩১ মার্চ’২০২০ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলার ডিসিদের সাথে কথা বলার সময় করোনা যুদ্ধে জয়লাভের জন্য বিভিন্ন গাইড লাইন প্রদান করেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশের জনগণের নিরাপত্তাই আমাদের কাম্য। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের আক্রমণের কারনে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। বাঙালির বাংলা নববর্ষ পালন ঘরে বসেই করতে হবে। সকলকে ঘরে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নিজের ভালো সকলকেই বুঝতে হবে।
ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলার সময় তিনি একথা পুনর্ব্যক্ত করেন। করোনাভাইরাসজনিত মহামারির কারণে বিশে^ দুর্ভিক্ষের আশ্কংা থাকলেও বাংলাদেশে খাদ্য সংকট হবেনা। তিনি বলেন, এখন ধান উঠছে। ধান কাটাও শুরু হয়ে গেছে। আগামিতেও ফসল উঠবে।
গত মার্চ মাসের ৮ তারিখে করোনাভাইরাস ইটালি হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। বলতে গেলে তখন থেকেই সরকার বেশ তৎপর । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন থেকেই ঘোষণা দিয়েছেন নি¤œ আয়ের লোকদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা কি হচ্ছে? এদেশের দিন মজুর, রিকসা-ভ্যান চালক, অটো-সিএনজি চালক, বিভিন্ন দোকানের হাজার হাজার কর্মচারি, কামার-কুমার, জেলে, তাঁতি, ফল-মুল বিক্রেতা, চায়ের দোকানদার, ফেরিওয়ালা, বীজ বিক্রেতা, হাটে বাজারের ওষুধ েিবক্রতো, মফস্বল এলাকার পত্রিকার হকার, পত্রিকার মালিক-শ্রমিক-কর্মচারি, বাস-ট্রাক চালক ও তাদের সহকারি, খুচরা ডিজেল ও পেট্রোল বিক্রেতাসহ নরসুন্দর বা সেলুনে চুল-দাড়ি কাটার শ্রমিকদের দুর্দিন চলছে। বর্তমানে দেশে এমন কোন মানুষ নেই যে সে অভাবে নেই। যার যার বলয়ের মাঝে চোখ বুঁজে নিরবে সব সহ্য করে চলেছে। নি¤œ আয়ের মানুষজন কেমন কষ্টে দিনাতিপাত করছে তা হৃদয়ঙ্গম করার লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম
সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হচ্ছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকার জন্য কালক্ষেপন কেন? তালিকা তো আছেই প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন, পেীরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে সকল খানার তালিকা আছে। এদের মধ্যে কে ধনী, কে মধ্যবৃত্ত এবং কে নি¤œবৃত্ত তা কেবল যাচাই বাছাই করলেই তো তথ্য পাওয়া যায়। সকল নাগরিকের এনআইডি কার্ড রয়েছে। শুধুমাত্র যাচাই বাছাই করা দরকার। এ কাজটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা অতি সহজেই সম্পন্ন করা যেতো। গরিবদের তথ্যভান্ডার রয়েছে প্রতিটি এনজিওর অফিসে। সদিচ্ছা থাকলে তাদের নিকট থেকে গরিব দুখিদের তালিকা করা যেতো। তালিকা প্রস্তুত করতে তো এতো দেরি হবার কথা নয়। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে গত ২১ এপ্রিল তারিখে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাসমুহের জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায় তিঘন্টা ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন। সেসময় তিনি সারা দেশের ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত ত্রাণ কমিটি গঠন করতে আওয়ামী লীগের সহযোগি সংগঠনগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন । বিভাগ ও জেলা পর্যায় থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত এই কমিটি বিস্তৃত থাকবে। তারা প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্তদের চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করবে। যাতে যথাযথ মানুষেরা ত্রাণ পান। তিনি ১৫ এপ্রিল-২০২০ তারিখ সন্ধ্যায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থানরত নেতাকর্মিদের এ নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন,ত্রাণ কমিটি ত্রাণ বিতরণের জন্য স্বেচ্ছাসেবক সরবরাহ করবে। আর কমিটি যে তালিকা দেবে প্রশাসন তা যাচাইকরে ত্রাণ বিতরণ করবে। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে টা কি? সময় কাল: ০১-০৫-২০২০ (চলবে)। (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ০৬/০৪/২০২৪