ফেলে আসা দিন গুলো -৫৩

— এবাদত আলী —

২০১৫ সালের ২৮ মার্চ শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় পাবনা জেলা পুলিশের সমাবেশ ও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতানুষ্ঠানে যোগদানের জন্য মাঠে প্রবেশ করতেই পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। এরপর প্রেস ও মিডিয়ার জন্য নির্ধারিত আসনে বসার পর পরই পুলিশ সদস্যগণ আমাদেরকে রজনীগন্ধা ফুল, সমাবেশের ব্যাজ, টুপি ও ক্রীড়ানুষ্ঠান সুচিসহ একটি বুকলেট প্রদান করলেন।
চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে খরতাপের অপবাদ থাকলেও সেদিনের বিকেলের আবহাওয়াটা ছিলো একটু ব্যতিক্রমধর্মী। মেঘে মেঘে সারা আকাশ ঢাকা পড়েছিলো। তাইতো সুর্যের আলো তা ভেদ করতে না পেরে এক ¯িœগ্ধ পরিবেশের আবহ সৃষ্টি করেছিলো যাতে পাবনা জেলা পুলিশ লাইনস মাঠে আগত ক্রীড়ামোদীগণকে কোন বেগ পেতে হয়নি। অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনো খানিকটা সময় বাকি। এই ফাঁকে উক্ত বুকলেটের অন্যান্য প্যারাগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেল্লাম। তাতে লেখা ছিলো, নারী ও শিশুদের প্রতি সদয় আচরণ করুন। সন্ত্রাস দমনে পুলিশকে সহযোগীতা করুন। ট্রাফিক আইন মেনে চলুন। নিরাপদ সড়ক ও বিপদ মুক্ত ভ্রমণ নিশ্চিত করুন। রাস্তা পারা পারে প্রথমে ডানে, পরে বামে, আবার ডানে তাকিয়ে চলুন। প্রতিবেশীর সাথে সৎভাব রাখুন, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করুন এবং একে অপরকে সাহায্য করুন। টিনেজার সন্তানদেরকে মাদক থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হউন। বাড়ির পরিচারিকা বা গৃহ ভৃত্যের ছবি সংরক্ষণসহ প্রাক পরিচয় যাচাই করে নিয়োগ করুন। ঈর্ষণীয়, বর্ণাঢ্য ও ধনাঢ্য চালচলন পরিহার করে নিজেকে শত্রুমুক্ত রাখুন। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রত হউন ইত্যাদি ইত্যাদি আহ্বান।
যাক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এর এ্যাডিশনাল আই জি (এ এন্ড ও) মোঃ মোখলেসুর রহমান, বিপিএম (বার), বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ পুলিশ রাজশাহী রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মোঃ ইকবাল বাহার পুলিশ প্যারেড ময়দানের অভিবাদন মঞ্চে আসীন হলে পাবনার পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দি আহম্মেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। শুরুতেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহনকারি পুলিশ সদস্য বিশেষ করে তৎকালে আটঘরিয়া থানায় কর্মরত পুলিশের এ এস আই আব্দুল জলিল যিনি ২৯ মার্চ পাবনা সদর উপজেলার মালিগাছা নামক স্থানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে প্রানপণ লড়াই করে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করার পর শাহাদৎ বরন করেন, যার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙা উপজেলার বড়ভাগ গ্রামে এবং যার কবর পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর বাজার জামে মসজিদ সংলগ্ন উত্তর পাশে অবস্থিত সেই অকুতভয় শহীদ পুলিশ সদস্যের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কল্পে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিটি নিরবতা পালন করা হয়। স্মর্তব্য যে, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথমেই ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনীর উপর আক্রমণ করে বসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে পুলিশ বাহিনীই সর্বপ্রথম পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুধু তাই নয় শহীদ এ এস আই আব্দুল জলিলের নাম পাবনা পুলিশ লাইনস এর শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে এক নম্বর ক্রমিকে এবং ঢাকা পুলিশ হেডকোর্টার শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে পাঁচ নম্বর ক্রমিকে লিপিবদ্ধ রয়েছে তাদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এরপর জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে প্রধান অতিথি কর্তৃক জাতীয় পতাকা এবং বিশেষ অতিথি কর্তৃক পুলিশ বাহিনীর পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রধান অতিথি কর্তৃক পাবনা পুলিশের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী ঘোষণার মাধমে আকাশে ফেষ্টুন ও বেলুন উড়ানো হয়। সেই সাথে শ্বেত কপোতও অবমুক্ত করা হয়। মশাল প্রজ্জলনের পর পুলিশ সদস্য শহিদুল ও মৌসুমি মশাল দৌড়ে অংশ নেন। ক্রীড়া শপথবাক্য পাঠের পর প্যারেড অুনষ্ঠিত হয়। প্যারেড পরিচালনা করেন পাবনা পুলিশ লাইনস এর আর আই খাদেম আলী মোল্লা। এরপর আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক ভঙ্গিমায় মাঠ প্রদক্ষিণ করে জেলা পুলিশের বাদক দল।
পুলিশের প্রায় দু শ সদস্য বার্ষিক এই ক্রীড়ানুষ্ঠানের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন। পুরুষ ও মহিলা সুধিজনদের জন্য রাখা হয় পৃথক পৃথক ইভেন্ট। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মন মাতানো ডিসপ্লে প্রদর্শন করে পাবনা পুলিশ লাইনস স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। প্রতিযোগীতায় বালিশ যুদ্ধ, এলার্ম প্যারেড, শিশুদের বিস্কুট দৌড়, আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য বেলুন ফাটানো, বাজনা থামলে বালিশ কোথায় এবং সবশেষে আকর্ষণীয় ইভেন্ট যেমন খুশি তেমন সাজো।
পাবনা জেলা পুলিশের এই আয়েজনে অংশ নেন পাবনা জেলা পরিষদ প্রশাসক এম সাইদুল হক চুন্নু, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বেঞ্জামিন রিয়াজি, পাবনার আদালতের বিচারকগণ,রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারগণ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পাবনা জেলা ইউনিট কমান্ডের কমান্ডার হাবিবুর রহমান হাবিব, পাবনা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান শাওয়াল বিশ্বাস, পাবনা জেলার বিভিন্ন থানার পুলিশ সদস্যগণ, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি রেজাউল রহিম লাল, আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ আব্দুল হামিদ মাস্টার, শ্রী চন্দন চক্রবর্তী, অ্যাডভোকেট তসলিম হাসান সুমন, শাহজাহান মাহমুদ, পাবনা চেম্বারের সিনিয়ির সহ সভাপতি মাহবুব উল আলম মুকুল, ইউনিভার্সাল গ্রুপের জেনারেল ম্যনেজার অচিন্ত কুমার ঘোষ, রানা প্রোপার্টিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন বিশ্বাস রানা, মাসপো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রোটারি ক্লাবের ডেপুটি ডিষ্ট্রিক গভর্ণর আলী মোর্তুজা সনি বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ রাসেল আলী মাসুদ,
শিক্ষা বিভাগের সাবেক ডিজি এবং বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি কল্যান সমিতি পাবনা জেলা শাখার সভাপতি মির্জা শহীদুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের ডি আইজ ইকবাল বাহারের পিতা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল জব্বার, ডাঃ মনোয়ারুল আজিজ, আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হোসেন মোহন, পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল্লাহ বিশ্বাস প্রমুখ।
সাংবাদিকদের মধ্যে পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি, সাবেক সহ-সভাপতি কামাল আহমেদ সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক আহমেদুল হক রানা, প্রেক্লাবের সাবেক সম্পাদক এনটিভি ও সমকালের স্টাফ রিপোর্টার এবি এম ফজলুর রহমান, দৈনিক জোড় বাংলা সম্পাদক ও বিটিভি পাবনা প্রতিনিধি আব্দুল মতীন খান, দৈনিক সিনসা সম্পাদক এস এম মাহবুব আলম, দৈনিক নতুন বিশ্ব বার্তা সম্পাদক শহীদুর রহমান শহীদ, দৈনিক নতুন চোখ এর সম্পাদক ও প্রকাশক এসএম আলম, দৈনিক পাবনার খবর ও ডেইলি মর্ণিং টাচ সম্পাদক এমজি বিপ্লব চৌধুরী, প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবাদত আলী, ডেইলি অবজারভার প্রতিনিধি নরেশ মধু, পাবনা প্রেসক্লাবের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদ, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি পাবনা জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মজিদ দুদু, দি বাংলাদেশ টু ডে প্রতিনিধি আব্দুল হামিদ খান, দৈনিক বিবৃতির নির্বাহী সম্পাদক ও আলোকিত বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী মাহবুব মোর্শেদ বাবলা, দৈনিক ইছামতির বার্তা সম্পাদক আখিনুর ইসলাম রেমন, প্রধান প্রতিবেদক ছিফাত রহমান সনম, বাংলাদেশ বেতার প্রতিনিধি শুশীল তরফদার, সাংবাদিক এস এম আলাউদ্দিন, চ্যানেল নাইন ও দৈনিক যায় যায় দিনের পাবনা প্রতিনিধি আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, আর কে আকাশ, লাজুক, আমাদের সময় প্রতিনিধি সুশান্ত সরকার, দেশ টিভির পাবনা প্রতিনিধি জি কে সাদী, মাছরাঙা টেলিভিশিনের পাবনা প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম রিজু, বাসসের পাবনা প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম সুইট, জিটিভির পাবনা প্রতিনিধি ইমরোজ খন্দকার বাপ্পী, এ টি এন নিউজের পাবনা প্রতিনিধি রিজভী রাইসুল ইসলাম জয় প্রমুখ সাংবাদিক বৃন্দ।এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। খেলা শেষে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। স্যান্ডউইস, মিষ্টি, কমলা, পান করানো হয় চা।
এরপর পুরুষ্কার বিতরনের পালা। তার আগে প্রধান অতিথি পুলিশের এ্যাডিশনাল আইজিপি মোঃ মোখলেসুর রহমান এক সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্য পুর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, পুলিশ জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জনগণের বিপদে পুলিশ নিঃস্বার্থ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে জনমনে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রমাণ করে পুলিশ জনগণের বন্ধু। পুলিশের উপর দেশের মানুষের আস্থা রয়েছে। দেশের মানুষের সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে পুলিশ জীবন উৎসর্গ করে, পঙ্গুত্ব বরণ করে দেশের শান্তি রক্ষার জন্য নাশকতাকারি, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপকারি, মানুষ হত্যাকারি, নৈরাজ্যকারিদের প্রতিহত করছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। তান্ডব লীলা চালানোর জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। বাংলাদেশ পুলিশ দেশকে তালেবানী রাষ্ট্র হতে দেবেনা। পুলিশ জীবন দিয়ে হলেও তান্ডব লীলা বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে।” ভাষণের পররপরই তিনি বিজয়ীদের হাতে পুরুষ্কার তুলে দেন।
একই স্থানে রাত আটটায় অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী বাপ্পা মজুমদার ও ঝিলিক এবং কুষ্টিয়ার লালন সঙ্গীত দল সঙ্গীত পরিবেশন করে মুগ্ধ করে অগনিত শ্রোতাদের। পুলিশের বার্ষিক সমাবেশ ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ঘিরে জেলার সকল উপজেলার পুলিশ কর্মকর্তা বৃন্দ এবং আগত অতিথিবৃন্দ একসাথে হয়েছিলেন আনন্দময় এক পরিবেশে যা ফেলে আসা সেই দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
(লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব
তারিখ: ০৩/০৪/২০২৪.