// সঞ্জু রায়ঃ
৮ই মার্চ নানা আয়োজনে সারাবিশ্বে একযোগে পালিত হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আর এই নারী দিবসে লাখো নারীদের কাছে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা হতে পারেন পুলিশ কর্মকর্তা ‘সাবিনা ইয়াসমিন’। নানা চড়াই উতরায় পেরিয়ে তৃণমূলের মেয়ে সাবিনা আজ বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কর্মরত আছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) হিসেবে। সংসার সামলানোর পাশাপাশি সাবিনা ইয়াসমিন আজ দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে, পুরুষ কর্মকর্তাদের সাথে পুলিশিং কর্মকাণ্ডে সমদক্ষতা দেখিয়ে একাধিকবার শ্রেষ্ঠত্বও ছিনিয়ে নিয়েছেন তার কর্মজীবনে। সততা, হাস্যজ্জ্বল ভাল ব্যবহার আর দেশের জন্যে কিছু করার পেশাদারিত্বের মানসিকতায় সাবিনা ইয়াসমিন আজ বাংলাদেশ পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য। নারী দিবসে জানবো পুলিশ কর্মকর্তা সাবিনার এই জীবনযাত্রার গল্প যা অনুপ্রেরণা যোগাবে এই বাংলার লাখো নারীদের।
ভারতের সীমানা ঘেঁষে যশোর জেলার বেনাপোলে জন্ম নেয়া সাবিনার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে বর্ডার এলাকাতেই। চার ভাইবোনের মধ্যে সাবিনা গ্রাম্য ডাক্তার বাবা ও গৃহিনী মায়ের দ্বিতীয় সন্তান যে ছোটবেলা থেকে অদম্য মেধার অধিকারী। দুরন্ত স্বভাবের কারণে তার গৃহিণী মায়ের মনে ছিল সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা। একদিকে মেয়ের দুরন্তপনা অন্যদিকে মেয়ের শ্যামলা বর্ন নিয়ে মায়ের মনে কিছুটা সংশয় থাকলেও বাবার মনে ছিল মেয়েকে নিয়ে অনেক উচ্চাকাক্সক্ষা। তার বাবা বলত, “মেয়ে আমার ডাক্তার হবে, সে কলম ঘুরিয়েই খাবে। মাকে সতর্ক করে বলত, আমার মেয়ে খুবই মিস্টি, কোন আজেবাজে কথা বলবে না তুমি”। নুন আনতে পানতা ফুরানোর মতো সংসারে একসাথে ৪ ভাইবোনের খরচ চালানো সত্যি ফার্মাসিস্ট বাবার পক্ষে খুবই প্রতিকূল ছিলো যদিও তা আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয় সাবিনাদের জীবনে। জীবনে যে যুদ্ধ করে এগিয়ে যেতে হবে তা ছোটতেই শিখে নিয়েছিলো সে। বেনাপোল রেসিডেন্সিয়াল প্রি-ক্যাডেট স্কুলে হাতেখড়ি নিয়ে স্কুলের দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে বেসরকারী বৃত্তি লাভ করে। এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে সরকারি বৃত্তি পায়। সাবিনার বড় ভাই বরিশাল ক্যাডেট কলেজে পড়ায় ষষ্ঠ শ্রেণীতে বাবার ইচ্ছাতে তৎকালীন মেয়েদের একমাত্র ক্যাডেট কলেজ ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজে চান্সও পেয়েছিলো সাবিনা কিন্তু বাঁধ বাঁধল শৃঙ্খলার বেড়াজাল থেকে মুক্ত স্বাধীন চেতা দুরন্তপনা এই মেয়েটি পড়বে না ক্যাডেট কলেজের শৃঙ্খলা ঘেরা পরিবেশে। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হল বেনাপোল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। মেয়েটি বাবার কথা রেখে অষ্টম শ্রেণীতে থানার মধ্যে ফাস্ট হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল, আর পিছু তাকাতে হয়নি তাকে। মাধ্যমিকে পেল সিজিপিএ “৫”। বোর্ড বৃত্তি নিয়ে সাবিনা ভর্তি হয় দেশসেরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। মেডিকেলে চান্স না পাওয়ায় গ্রাম্য ডাক্তার আদর্শ একজন বাবার মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন ভঙ্গ হলেও মেয়েটি চেয়েছিল সে তার জীবনকে উপভোগ করে স্বাধীনভাবে পড়াশুনা করবে আর তার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ফাষ্ট ক্লাস নিয়ে অনার্স সম্পন্ন করার পর হলের সহপাঠীরা যখন বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত সাবিনার মনেও বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিলো। মাস্টার্স এর পড়াশোনা, নিজের খরচ চালাতে টিউশনি আর বিসিএস প্রস্তুতি সব মিলিয়ে মেধা ও বাবা-মায়ের দোয়ায় গ্রামের সেই দূরন্ত সাবিনা উর্ত্তীণ হয়ে যায় ৩৩তম বিসিএসে দ্বার উন্মোচন হয় বাংলাদেশ পুলিশের ক্যাডার কর্মকর্তা হওয়ার। প্রশিক্ষণ শেষে প্রথম খুলনা জেলায় শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছিলো সাবিনা। এরই মাঝে ২০১৬ সালে থানায় বাস্তব প্রশিক্ষনকালীন সাবিনার বিয়ে হয় ৩৩ তম বিসিএস এর শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার সাথে। পরবর্তীতে সাবিনা মা হলে স্বামী-সন্তানের সংসার সামলানোর পাশাপাশি সামলেছেন নিজের পরিবারকে আবার পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে মাঠপর্যায়ে খুব অল্প দিনের মাঝেই মনজয় করে নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের। ২০১৯-২০২১ সালে রাজশাহী রেঞ্জের ৮টি জেলার মধ্যে একমাত্র নারী সার্কেল অফিসার হিসেবে বগুড়া জেলার গাবতলীতে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। বগুড়ায় দায়িত্ব পালনকালে বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত গাবতলী ও সারিয়াকান্দিতে সাবিনার নেতৃত্বে জনবান্ধব পুলিশিং সেবা নিশ্চিতকরণ, বিট পুলিশিং কার্যক্রম, ৯৯৯ সেবায় আমূল ইতিবাচক পরিবর্তন, দুর্গম চরের সন্ত্রাস ও ডাকাতি বন্ধে ইতিবাচক পরিবর্তনসহ ক্লুলেস হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধি ও বয়স্ক হেল্প ডেস্ক কার্যক্রম যা পুরো বগুড়াতে সমৃদ্ধ করায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে এই নারী পুলিশ কর্মকর্তা। তৎকালীন বগুড়া জেলার পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় সাবিনা ইয়াসমিন সার্কেলের অতিরিক্ত কাজ হিসেবে সকল থানাতে নারী শিশু হেল্প ডেস্ক স্থাপন, প্রোমটিং ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রত্যেক থানার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনসচেতন মূলক প্রোগ্রাম পরিচালনা করে বগুড়া জেলার সাধারণ মেয়েদের কাছে অল্প সময়ে হয়ে উঠে একটি আদর্শের নাম। ২০১৯ সালে নারী শিশু হেল্প ডেস্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বগুড়া জেলা মডেল হয়। নির্যাতিত নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করাই তৎকালীন ইন্সেপেক্টর জেনারেল ড. জাবেদ পাটোয়ারীর কাছ থেকে স্কীকৃতিও অর্জন করে সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা সাবিনা। সততা, কর্মদক্ষতা, মেধা ও পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রেখে বগুড়া জেলায় বেশ কয়েকবার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সার্কেল এএসপির পুরস্কার।
অতঃপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে যায় নওগাঁ জেলা। সেখানে সে দায়িত্ব পায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর এর পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) এবং তৎকালীন নওগাঁয় বহুল আলোচিত পুলিশ শপিং মলের সমস্ত কাজের তত্ত¡াবধায়ক হিসেবে। দিনরাত পরিশ্রম করে নওগাঁ জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়ার নেতৃত্বে স্বল্পতম সময়ে কাজ শেষ করায় সে সময়ের ইন্সেপেক্টর জেনারেল ড. বেনজীর আহমেদ নিজে এসে শপিং মল উদ্বোধনও করেছিলেন। প্রায় ২ বছর নওগাঁ জেলা পুলিশে কাজ করার পর ২য় সন্তানের মা হলে সাবিনা আবারও পোস্টিং নেয় ৪ এপিবিএন, বগুড়া। সেখানে সে দায়িত্ব পায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিকিউএম হিসাবে, আর তার একমাস পর সেখানে শুরু হয় টিআরসির ট্রেনিং। ৪ এপিবিএন এর তৎকালীন অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ আবু সায়েম ইতোমধ্যে তার দক্ষতাকে উপলব্ধি করে দায়িত্ব দেয় টিআরসির ট্রেনিং এর কোর্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। এপিবিএন এর অপারেশনাল ইউনিটে অভিযান পরিচালনা করা, স্কুল কলেজে সচেতনতা মূলক প্রোগ্রাম করে সেখানকার সাইবার ক্রাইম সেলকে শক্তিশালী করা, দীর্ঘ ৬ মাস টিআরসির মাঠ কার্যক্রম ও আইন অনুশীলন কাছ থেকে তদারকি করে পরিচয় দিয়েছেন সঠিক নেতৃত্বের। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন বিহীন প্রশিক্ষণের কঠিন সময়ে প্রশিক্ষনার্থীদের কারো কাছে সাবিনা ইয়াসমিন ছিল সত্যিকারের অভিভাবক বা কারো কাছে কর্মজীবনের আইডল। সর্বশেষ সাবিনার পোস্টিং হয় আরএমপি, রাজশাহীতে। বর্তমানে তিনি আরএমপিতে এডিসি ক্রাইম এন্ড অপারেশনে দায়িত্বরত থাকলেও অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন এডিসি ফোর্স, এডিসি প্রসিকিউশন, এডিসি এস্টেট এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পদেও।
অত্যন্ত সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা মেয়ে সাবিনা ইয়াসমিনের বাবার ছিল একটি ওষুধের ফার্মেসি আর মা গৃহিণী। ফার্মেসি থাকার সুবাদে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করায় গ্রামের লোক সাবিনার বাবাকে ডাক্তার বলে ডাকত। যে মেয়েটি একদিন পরিচিত হত বাবার পরিচয়ে, কালাম ডাক্তারের মেয়ে হিসেবে। বাবার মৃত্যুর আগে সেই মেয়ে তার বাবাকে গর্ববোধ করাতে পেরেছিল, তার বাবা বলেছিল, “আজকে সবাই তাকে বলে এএসপির বাবা” মেয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে পেরে ভীষণ গর্ব অনুভব করেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর দূরন্ত সেই সাবিনা আজ তার ছোট ভাই বোনের পড়াশুনা থেকে শুরু করে পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ঘর-সংসার, সন্তান সামলিয়ে সমস্ত প্রতিক‚লতাকে ছাপিয়ে কর্মস্থলে নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অনেক অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে দিচ্ছেন যে “আমরা নারী, আমরাও পারি”। পুলিশ কর্মকর্তা সাবিনা আজকের এই বদলে যাওয়া বাংলাদেশে হতে পারেন লাখো সংগ্রামী নারীর কাছে একটি অনুপ্রেরণার নাম। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন সাহসী নারীদের প্রতি স্যালুট। যুগে যুগে বাংলার মাটিতে এগিয়ে যাক সাবিনার মতো নারীরা, সমৃদ্ধ হোক এদেশ। বৈষশ্য ভুলে গড়ে তুলি আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ স্বপ্ন হোক এটি।