উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক খাজা শাহ এনায়েত পুরী (রঃ)

— এবাদত আলী —
হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রঃ ) এর উত্তারসুরীদের মধ্যে যে ক’জন বুজর্গ আওলিয়ার নাম সুফি ইতহাসে অম্লান হয়ে রয়েছে-উনবিংশ-বিংশ শতকের সুফি সাধক খাজা শাহ এনায়েত পূরী (রঃ) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আসাম বংলার লাখ লাখ মানুষের ভক্তিভাজন পীর হিসাবে খ্যাত।
খাজা শাহ এনায়েত পুরীর পুরো নাম শাহ মোহাম্মদ ইউনুছ আলী (রঃ)। তিনি বাংলা ১২৯৩ সনের ২১ কার্তিক (হিজরী ১৩০৩ সনের ১১ জিলহজ্ব) শনিবার ভোর রাতে তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার এনায়েত পুরে (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) পিতৃ গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত খাজা শাহ এনায়েতপুরীর পুর্ব পুরুষগণ বাগদাদের বড় পীর হযরত অব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এর বংশধর ছিলেন। হযরত বড় পীরের খান্দানের সুফী সাধক সায়েখ ইসমাইল ও শেখ বাহাদুর নামে দু বুজর্গ পরিবারের কিছূ ব্যক্তি দিল্লীতে আগমণ করেন। নবাবী আমলে তাঁরা মীর বলে পরিচিত হতেন। মুর্শিদাবাদ ইংরেজ কবলিত হলে এ বংশীয় বুজর্গ ব্যক্তিগণ মীরজাফরের কোপানলে পতিত হন এবং মুর্শিদাবাদ ছেড়ে নদী পথের গঙ্গার পুর্বপাড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নেন। মোমেনশাহীর জাফর শাহী পরগনার যে বনভূমিতে তাঁরা আশ্রয় নেন তার নাম করণ করা হয় এনায়েত পুর। এনায়েত শব্দের অর্থ দান। সম্ভবত সে অর্থেই এনায়েত পুর নামকরণ করা হয়েছিলো বলে ফকির আফতাব উদ্দিন রচিত একটি পুস্তিকা হতে জানা যায়।
খাজা শাহ এনায়েত পুরীর পিতার নাম শাহ আবদুল করিম এবং মাতার নাম তামিরন নেছা। তাঁর নানার নাম মুন্সী শহর উল্লাহ। মুন্সী শহর উল্লাহ সে সময় পায়ে হেঁটে হজ্বব্রত পালেন করেছিলেন বলে জানা যায়। খাজা শাহ এনায়েত পুরীর পিতা পশ্চিম বঙ্গের হুগলী মাদরাসা হতে কোরআন, হাদীস, ফেকাহ ও শরিয়ত শিক্ষার উচ্চতর সোপান অতিক্রম করেন। ধর্মশাস্ত্রে বহু গ্রন্থ পাঠ করে তিনি পরবর্তী কালে একজন উচ্চ শ্রেণির আলেমের খ্যাতি লাভ করেছিলেন। খাজা এনায়েত পুরীর পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন।
মাতার নিকটে তিনি বাল্য শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর মাতা ছিলেন কোরআনের হাফেজ এবং আরবী ও ফারসী ভাষায় উচ্চ জ্ঞানের অধিকারিনী। এ ছাড়া তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায় ও তিনি শিক্ষা লাভ করেন। কৈশর বয়স অতিক্রম কালেই তিনি ছিয়াছিত্তা হাদিস ও তফসীরে পান্ডিত্য অর্জন করেন। মৌলনা রুমী, ইমাম গাজ্জালী, শেখ সাদী, শেখ ফরিদ এবং হাফিজের তিনি উৎসাহী পাঠক ছিলেন। তাঁর পিতার বারো হাজার শব্দ সম্বলিত এক খানি আরবী-ফারসী লোগাত যা হস্তলিখিত তা তাঁর মুখস্ত ছিলো। তিনি দেওয়ানে ওয়েছির (সুফি হযরত ফতেহ আলী (রঃ) ) এর বহু শ্লোকের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন।
সুফি সাধক খাজা শাহ এনায়েত পূরী মাত্র সতের বছর বয়সে পীরের নিকট বয়াত গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে জনৈক নজর আলী লিখিত একটি নিবন্ধ হতে জানা যায়,যে, সেই সময় রমজান মাসের এক রাতে খাজা এনায়েতপুরীর মাতা সপ্নে দেখেন দক্ষিন-পশ্চিম আকাশে আল্লাহর নূর অবতীর্ন হয়েছে। এর কয়েক দিন পর সিরাজ গঞ্জের চিনাধুকুরিয়া গ্রামে হযরত ওয়াজেদ আলী (রঃ) নামে একজন মহান ওলির আগমন ঘটে। প্রতিদিন সেখানে গিয়ে বহু লোক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করছেন। এ সংবাদ জানার পর স্বপ্নের মাহাত্ম বুঝতে পেরে তাঁর মাতা তাঁকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকেই শাহ এনায়েত পুরীর জীবনে আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু হয়। তিনি তাঁর পীরের সঙ্গে কলকাতা গমন করেন। তখন হযরত ওয়াজেদ আলী (রঃ) এর খানকা ছিলো গোবরাবাগে। এর আগে তিনি মেহেদীবাগেও একটি খানকা স্থাপন করেছিলেন।
খাজা শাহ এনায়েতপুরী প্রায় বারো বছর কাল যাবত তাঁর পীরের সহবতে থেকে কঠোর সাধনা করে সৈয়দ সাহেবের মুরিদদের মধ্যে তিনি সর্বোচ্য স্থান অধিকার করে পীরের খেলাফত লাভ করেন। সৈয়দ ওয়াজেদ আলী সাহেবের সহবতে এসে হযরত এনায়েতপুরীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের পথ খোলাসা হয়। মোহাম্মদ মনসুর চৌধুরী কতৃক লিখিত একটি পুস্তকে তাঁর এই রূহানী বিদ্যা অর্জনের ব্যাপারে একটি চমৎকার কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে।
একদিন সৈয়দ ওয়াজেদ আলী সাহেব হযরত এনায়েতপুরীকে স্নেহের সুরে বল্লেন, বাবা তোমার দাদা পীরের মাজার শরীফে গিয়ে ধ্যানে বসো। মুরশীদ কেবলার আদেশ পেয়ে তিনি তাঁর দাদা পীর হযরত শাহ সুফি ফতেহ আলী (রঃ) এর মাজার শরীফে মুরাকাবায় বসলেন। এক সময় আকাশ পাতাল মুখরিত হয়ে উঠলো। যেন ভূমিকস্প শুরু হলো। দুনিয়া আলোড়িত হয়ে কেঁপে উঠলো। মহান আল্লাহর অসীম কুদরত বুঝা ভার। গায়েবী মদদে সুফি সাহেবের মাজার শরীফ ফেটে গেলো। তিনি মাজার শরীফ থেকে বের হয়ে এলেন। এর পর এনায়েতপুরীকে বল্লেন, তুমি কুতুব হবে না গাউস হয়ে যাবে। এ কথা বলেই তিনি এনায়েতপুরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করলেন। হযরত এনায়েতপুরীর তখন ইলমে সিনা হাসিল হলো।
তাঁর খিলাফত প্রাপ্তি সম্পর্কে আরো জানা যায় যে, একদিন সৈয়দ সাহেবের দরবার মুরিদদের আগমনে সরগরম। মুরিদগণ ধূমধামের সাথে পীরের খেদমত করছেন। কয়েকজন মুরিদ সৈয়দ সাহেবকে গিয়ে বল্লেন, হুজুর আমাদের খিলাফত দিন। সৈয়দ সাহেব তখন মুরিদগণকে হুজরা শরীফে ডেকে বল্লেন পীরের নিকট খিলাফত চাইতে নেই। মুরিদের যোগ্যতা দেখে পীর খিলাফত দান করেন। পীরের নিকট খেলাফত চাওয়া বেয়াদবী। এরূপ বয়ান করতে গিয়ে হঠাৎ তিনি ভাবে বিভোর হয়ে পড়লেন। এরপর যাকে সামনে পেলেন তাকেই লাঠি দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। মুরিদগণ সকলেই ভয়ে পালিয়ে গেলেন। কিন্তু এনায়েতপুরী তখনো বসে রইলেন। সৈয়দ সাহেব তাঁকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন। সে কি আঘাত, চলছে তো চলছেই। তা দেখে সৈয়দ সাহেবের দু পুত্র এগিয়ে এলেন। সৈয়দ সাহেব তখন লাঠি ফেলে দিয়ে বল্লেন সে কি মানুষ না কাঠ! আমি তাকে এত মেরেছি সে একটুও আহ! উহ! শব্দ করলোনা। এরপর পলাতক মুরিদদের উদ্দেশ্যে তিনি বল্লেন, পীরের লাঠির সামান্য আঘাত যারা সহ্য করতে পারেনা তারা আবার খিলাফত দাবি করে। এর পর সেদিন সকল মুরিদদেরকে ডেকে তাঁর হুজরা শরীফে বসিয়ে পঞ্চাশটি পাগড়ী পঞ্চাশ জনকে পরিয়ে দিলেন। সব শেষে তিনি শাহ সুফি এনায়েতপুরীকে বল্লেন, বাবা তুমি তো মজ্জুব হালে আলু থালু বেশে থাকো, আমার দরবারে খেদমত করো- তুমি আমার এই খিরকাটাই নাও। এ কথা বলে তিনি এনায়েতপুরীর মাথায় তাঁর ব্যবহ্রত পাগড়ী মোবারক পরিয়ে দিলেন। সেই সাথে তাঁর পবিত্র খিরকাও দান করলেন তাঁকে। আজো সেই পাগড়ী ও খিরকা মোবারক ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে তাঁর পুত্র হযরত মওলানা মরহুম খাজা ছাইফুদ্দিন শাহ এর লালকুঠি দরবারে আছে বলে জানা যায়।
খাজা শাহ এনায়েতপুরী ১৩২০ সাল থেকে তাঁর প্রচার কাজ শুরু করেন। এ সম্পর্কে একদিন তাঁর পীর একটি গজলের কিছু অংশ তাঁকে শোনান।
গোলমে ফুল চামেলী
নরগেছ খাড়ে একলী
গোলাবে নামে মীরব
কাটুকা বন চমকেলী। অর্থাৎ নার্গিস চামেলী ফুল এমনিতেই ফোটে, কিন্তু গোলাপ তা পারেনা। গোলাপ শত বাধা পেরিয়ে কাঁটার ভিতরে ফোটে। সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (রঃ) সাহেব তাঁকে গঙ্গার পুর্বপাড়ের অধঃপতিত, দরিদ্র লোকদের মাঝে প্রচারের নির্দেশ দেন এবং সমাজের মজলুমদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য দোয়া করতে বলেন।
তাই হযরত খাজা এনায়েতপুরীর প্রচারের ক্ষেত্র ছিলো ভূমিহীন কৃষক,নিরন্ন মজুর, উপেক্ষিত তাঁতী, জেলে, কর্মকার, কুম্ভকার প্রভৃতি সমাজের নিঃস্বদের মধ্যে। এ ধরনের লোকদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিলো সীমাহীন। তিনি তাদেরকে বাবা বলে সম্বোধন করতেন। নকশবন্দি মোজাদ্দেদী তরিকার এই সুফি সাধক তাঁর মুরিদ দেরকে আপনি বলে ডাকতেন। কখোনো কাউকে তিনি তুমি বলতেন না। হযরত খাজা শাহ সুফি ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) একটি শ্যাওড়া গাছের নিচে বসে মুরিদ দের মনের আশা আকাংখার কথা শুনতেন।
কথিত আছে একবার জামাল পুর হতে কয়েকজন লোক তাঁর দরবারে এসে তরিকা গ্রহণ করেন। তারা বিদায় নেওয়ার সময় হুজুরের সঙ্গে দেখা করবেন আশায় হুজরা শরীফের সামনে বলাবলি করছে যে, আমরা তো হুজুরের কোন কারামতি দেখলামনা। কিছুক্ষণ পর শাহ এনায়েতপুরী (রঃ) বাইরে এসে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বল্লেন, বাবারা আপনারা কি পুর্বে দিলের জিকির বুঝতেন? তারা বল্লেন না। এবারে হযরত এনায়েতপুরী ফরমালেন- এখন কি বুঝতে পারছেন? তারা সকলেই বল্লেন জি হুজুর। তিনি বল্লেন, বাবারা এর চেয়ে বড় কারামত আর কি চান।
সুফি সাধক খাজা শাহ এনায়েতপুরী (রঃ) ১৩৫৮ সালের ১৮ ফাল্গুন (ইং ১৯৫২ সাল) ৬৩ বছর ৬ মাস বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েত পুরে তাঁর মাজার শরীফ অবস্থিত। প্রতি বছর ওরছের সময় লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটে থাকে। প্রতি দিন ও রাতভর হামদ, নায়াত,জিকির আজকার, খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ওরছ মজলিসে পবিত্র ফাতেহা পাঠ পুর্বক তামাম দুনিয়ার নবী, আওলিয়া, মুমিন মুসলমানের রূহে ছোয়াব রেছানীর উদ্দেশ্যে দোয়া খায়ের করা হয়।
এ ছাড়া হযরত খাজা শাহ এনায়েতপুরীর ওফাত দিবস উপলক্ষে দেশ বিদেশের বহু খানকায় ছোয়াব রেছানীর এন্তেজাম করা হয়। এ গুলোর মধ্যে দরবারে মোজাদ্দেদীয়া, প্যারাডাইস পাড়া, টাংগাইল, শম্ভুগঞ্জ লালকুঠি দরবার, ফরিদ পুরে বিশ্বজাকের মঞ্জিল ও চন্দ্রপাড়া দরবার। ভারতের আসামের দরঙ, নওগাঁ, কামরূপ, গোয়াল পাড়া, ডিব্রুগড়, লক্ষীপুর এবং বিলোটিয়া এর সত্যগুরুর দরবার উল্লেখযোগ্য। (লেখক সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।

 এবাদত আলী 
 সাংবাদিক ও কলামিস্ট
 তারিখ ০১/০৩/২০২৪.