মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)এর মেরাজে গমণ


— এবাদত আলী —

মহা নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভের ১১ তম বর্ষে পবিত্র রজব মাসের ২৬ তারিখে দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভের জন্য উর্ধ্বারোহন করেন। যাকে মেরাজ বলা হয়। রাতকে ফারসি ভাষায় বলা হয় শব। আরবিতে বলা হয় লাইলাতুল মিরাজ। মিরাজ শব্দটি আরবি। এর অর্থ সিঁড়ি, উর্ধগমণ ইত্যাদি। বিশেষ অর্থে শব্দটি বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দিদার লাভের জন্য যে বিশেষ সফরে মহাশুন্য ছাড়িয়ে অতি উর্ধলোকে সেই আল্লাহ পাকের আরশে আজিমে উপনীত হয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয।
মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) তায়েফবাসির অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে অবশেষে নিজ মাতৃভূমি মক্কা নগরীতে উপনীত হন। হজরত জায়েদ (রা.) এর মাধ্যমে মুতায়েমের সহায়তায় তিনি মক্কা নগরীতে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর অর্থাৎ হিজরতের এক বছর আগে রজব মাসের ২৭ তারিখে তিনি মে’রাজে গমণ করেন।
মহানবী (সা.) হজরত উম্মে হানির গৃহে শায়িত ছিলেন। গভীর রাতে হজরত জিবরাঈল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.) সেখানে উপস্থিত হয়ে নবী করিম (সা.) কে উঠিয়ে বিদ্যুতের ন্যায় বেগবান একটি বাহন যার নাম বোরাক তাতে সওয়ারি অবস্থায় কাবা শরীফের হাতিমে অবতরণের পর হজরত জিবরাঈল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.) এর নেতৃত্বে হজরত নবী করিম (সা.) এর ‘সিনা চাক’ করা হয়। কলবকে ঐশি কায়দায় ধৌত করে পুনরায় যথাস্থানে স্থাপন করা হয়। এই ভাবে আল্লাহর হাবিবকে আল্লাহর পবিত্র সান্নিধ্যে গমণের এবং অদৃশ্য জগতের নিদর্শনরাজি পরিদর্শনের উপযুক্ত করে তোলা হয়। সিনা চাক পর্ব সমাধার পর হজরত নবী করিম (সা.) এর স্কন্ধে মোহরে নবুয়্যত সংযোজিত হয়।
অতপর বোরাক যোগে আল্লাহর নামে পবিত্র সফর আরম্ভ হয়। মূহুর্তের মধ্যে বায়তুল হারাম থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছে তথায় বোরাককে একটি পাথরের ছিদ্রে বাঁধা হয় এবং বহু সংখ্যক নবী রাসুল এবং ফেরেশতাদের উপস্থিতিতে নবী করিম (সা.) এর ইমামতিতে দু রা’কাত নামাজ আদায় করেন। হজরত সোলায়মান (আ.) এর প্রতিষ্ঠিত এবং হজরত ইসা (আ.)এর স্মৃতি বিজড়িত জেরুজালেম মসজিদ যা এতদিন কেবলা করে নামাজ আদায় করতেন। তা দর্শনে নিজেকে ধন্য মনে করলেন। অতপর হজরত মোহাম্মদ (সা.) বোরাকে আরোহন পুর্বক উর্ধলোকে গমণ শুরু করলেন। প্রথম আসমানে আদি পিতা হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া ও হজরত ইসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহীম (আ.) এর সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং সালাম বিনিময় করলেন। প্রত্যেকেই অতি আনন্দের সঙ্গে হজরতকে অভিনন্দিত করলেন।
সপ্তম আসমানে বায়তুল মা’মুর অবস্থিত। বায়তুল মা’মুর কা’বা শরীফের ঠিক উপরে অবস্থিত। বায়তুল মা’মুর হলো ফেরেশতাদের কেবলা। দৈনিক সত্তর হাজার নিত্য নতুন ফেরেশতা উক্ত ঘর তাওয়াফ করেন। যারা একবার তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন তাদের পূনরায় তাওয়াফ করার সুযোগ ঘটেনা। এর পর হজরত মোহাম্মদ (সা.) ‘সিদরাতুল মুনতাহা’তে উপনীত হলেন। হজরত (সা.) বেহেস্ত ও দোজখ পরিদর্শন করলেন এবং হজরত জিবরাঈল (আ.) কে প্রকৃত রুপে দেখতে পান। এছাড়া মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসংখ্য কুদরতের লিলা দর্শন পূর্বক তিনি বিমোহিত হন। এক সময় হজরত জিবরাঈল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.) মহানবী (সা.) এর নিকট হতে বিদায় প্রার্থনা করে বলেন “ হে আল্লাহর প্রিয় হাবিব আর আমদের অগ্রসর হবার অধিকার নেই। নবী করিম (সা.) এর জিজ্ঞাসার উত্তরে ফেরেশতাদ্বয় বলেন, “ আমরা যদি এই স্থান হতে চুল পরিমাণও সামনের দিকে অগ্রসর হই তাহলে আল্লাহ তায়ালার তাজাল্লীর তেজে আমাদের পালক ও ডানা সব পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাবে।” আপনি অতি ভাগ্যবান, তাই জীবিত অবস্থায় মহান আল্লাহ পাকের দিদার লাভে নয়ন মনের সার্থকতা সম্পাদন করবেন।’ অতপর হজরত মোহাম্মদ (সা.) কে উপরে নিয়ে যাবার জন্য আরশে মুয়াল্লা হতে ফেরেশতা ‘রফ রফ’ নামক নরম সবুজ গালিচার ন্যায় সওয়ারসহ উপস্থিত হলেন। হজরত মোহাম্মদ (সা.) রফ রফে সওয়ার হয়ে বিপুল আয়তন প্রাঙ্গন অতিক্রম করে আল্লাহর আরশ কুরসিতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর সান্নিধ্যে উনীত হলেন। আল্লাহর রাসুল বলে উঠলেন, “আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াছ সালাওয়াতু ওয়াত তাইয়্যেবাতু”। অর্থাৎ শারিরীক ও আত্মিক যাবতীয় কুরবানি ও এবাদত আল্লাহর সদনে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবের এই হাদিয়া সাদরে গ্রহণ করলেন এবং উত্তরে বললেন, “আচ্ছালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ও বারাকাতুহু।” অর্থাৎ আপনার উপর হে নবী আমার সালাম, রহমত ও প্রাচুর্য বর্ষিত হোক। উম্মতের দরদী নবী এই তোহফার সাথে উম্মতকে শরিক করে নিলেন এবং বললেন, “আচ্ছালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালেহীন। এই সালাম, রহমত ও প্রচুর্য আল্লাহ এবং আল্লাহর সকল নেক বান্দার উপর বর্ষিত হোক। অতপর আরশে মুয়াল্লার ফেরেশতাদের মুখ হতে উচ্চারিত হলো “আশহাদু আল লাই্লাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু। অর্থাৎ তারা আললাহর তৌহিদ ও মোহাম্মদ (সা.) এর রিসালতে স্বাক্ষ প্রদান করলেন।
নবী করিম (সা.) এর মে’রাজ সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআন শরীফে সুরা আন নাজমে এরশাদ করেছেন, “অতপর সে আসল আকৃতিতে দৃশ্যমান হয়েছিলো, এইভাবে সে উচ্চ প্রান্তে ছিলো। তৎপর সে নিকটে এলো। আরো নিকটে এলো, এমনকি দুই ধনুক পরিমাণ দূরত্ব রইলো। বরং আরো কম। অতপর আল্লাহ নিজ বান্দার প্রতি ওহি নাজিল করলেন- যা নাজিল করার ছিলো।’’
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট