// নাটোর প্রতিনিধি :
নাটোরের মরা আত্রাই নদীতে পানির গতিপথ বন্ধ করে অবৈধভাবে সোঁতি জাল বসিয়ে মাছ শিকারে শস্য ভান্ডার খ্যাত হালতিবিলের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমি এখন অবস্থান করছে পানির নিচে। ফলে চলতি মৌসুমে বোরো ধান চাষাবাদসহ বিভিন্ন রবিশস্য উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন সেখানকার কয়েক হাজার কৃষক। কেননা ইতোমধ্যে মৌসুম শুরু হলেও এসব জমি থেকে পানি না নামার কারনে কৃষকরা একদিকে সময় মত জমি প্রস্তুত করতে পারছেন না। অন্যদিকে সরিষা, কন্দ-পেঁয়াজ ভুট্রাসহ বিভিন্ন রবি ফসল চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কায় আছেন কৃষকরা। এতে কৃষির উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অথচ গেল বছর বোরোর চারা রোপণের আগেই এসব জমিতে কৃষকরা সরিষা, কন্দ-পেঁয়াজ ভুট্রাসহ বিভিন্ন রবি ফসল চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু এবার জমি থেকে পানি না নামার কারনে খানিকটা বিলম্বিত হচ্ছে। তবে আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে এসব জমি থেকে পানি অপসারন হলে সঠিক সময়ে বোরোর চাষাবাদ করা যাবে। পাশাপাশি বোরোর আগে সরিষাসহ বিভিন্ন রবিশস্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন কৃষক ও সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ। কিন্তু সেখানকার কৃষকদের গলার কাঁটা হয়েছে মরা আত্রাই নদীতে বসানো অবৈধ সোঁতি জাল। এসব সোঁতি জাল অপসারন করে ফসল উৎপাদনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়ে স্থানীয় দুই শতাধিক কৃষক স্বাক্ষরিত একটি লিখিত পত্র মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রদান করা হয়েছে।
স্থানীয় সুত্র, কৃষক ও লিখিত আবেদন সুত্রে জানাযায়, জেলার শস্য ভান্ডার খ্যাত হালতিবিলে আগে একমাত্র ফসল বোরো ধান ছাড়া অন্য কোন ফসলের চাষাবাদ হতো না। তবে গেল কয়েক বছর ধরে সরকারের সার, বীজ ও উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার সুযোগে এবং কৃষি বিভাগের সহযোগিতা ও পরামর্শের কারনে সেখানে প্রতি মৌসুমে বোরো ধান চাষাবাদসহ হরেক রকম রবি শস্য উৎপাদন হচ্ছে। বিশেষ করে ভোজ্য তৈল উৎপাদনে সষিরা এবং খাদ্য উৎপাদনে গম, ভুট্রা, কন্দ পেঁয়াজ, কাদায় রসুন, বাদামসহ হরেক রকম ফসল। কিন্তু এবার সেই চাষাবাদ নিয়ে অনেকটাই শঙ্কায় আছেন কৃষকরা। স্থানীয় প্রভাবশালীরা হালতিবিলের পানি নিষ্কাষণের একমাত্র পথ মরা আত্রাই নদীতে অবৈধ সোঁতি জাল বসিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে পানির গতি পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আর হালতিবিলের কৃষি জমি পানির নিচে অবস্থান করায় সময় মত ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন না কৃষকরা। পাশাপাশি বোরোর বীজতলা প্রস্তুত করতেও বিলম্ব হচ্ছে। অথচ সময় এসেছে জমি প্রস্তুত করে সরিষাসহ বিভিন্ন রবি শস্য চাষাবাদ।
হালতিবিল সংলগ্ন মরা আত্রাই নদীতে সিংড়া উপজেলা অঞ্চলে ত্রিমোহনী এলাকা থেকে হাপানিয়া, সোনাইডাঙ্গা ও বোক্তারপুর পর্যন্ত ছোট-বড় মিলে ১০ থেকে ১২টি স্থানে অবৈধ ভাবে সোঁতি জাল বসানো হয়েছে। প্রভাবশালী মহলের লোকজন এসব সোঁতি জাল বসিয়ে মাছ শিকারের নামে পানি অপসারনের গতিপথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। এছাড়া সোঁতি জালের সাথে বাঁশের চাটাই দিয়ে বিশেষ কায়দার পানি আটকিয়ে ¯্রােত সৃষ্টি করে শতশত মন মাছ শিকার করা হচ্ছে এসব স্থানে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনকে অবহিত করে এসব সোঁতি জাল অপসারন করা হলেও ফের একই স্থানে সোঁতি জাল বসানো হয়। সরিজমিনে গিয়ে, এসব ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। সোঁতি জালে কর্মরত শ্রমিকদের কাছে মালিকদের পরিচয় জানতে চাওয়া হলে তা কেউ বলতে রাজি হননি। কেননা সোঁতি জালের মালিকরা খুব প্রভাবশালী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজন শ্রমিক জানান, সোঁতি জালের মালিক কারা, তা তারা অনেকে জানেন না। শুধুমাত্র সকালে আসেন আর সন্ধ্যার দিকে পারিশ্রমিক বাবদ ৫০০ টাকা করে নিয়ে চলে যান। এভাবে তারা দিন-রাত পর্যায়ক্রমে কাজ করেন। আবার কেউ কেউ মালিকের পরিচয় জানলেও তারা বলতে পারবেন না। কারন তারা নাম প্রকাশ করলে তাদের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে তারা বলেন, এসব সোঁতি জালের পেছনে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত রয়েছেন। এজন্য চাইলেই এসব সোঁতি জাল অপসারন করা যায় না।
এদিকে হালতিবিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক কাউছার রহমান,শফির উদ্দিন মন্ডল, হালতি গ্রামের আফজাল হোসেন, একডালা গ্রামের জামাল হোসেনসহ আরো অনেকে অভিযোগ করে বলেন, সময়মত হালতিবিলের পানি অপসারন না হলে তাদের বীজতলা প্রস্তত করতে বিলম্ব হবে এবং বোরো চাষাবাদও এক মাস পিছিয়ে যাবে। গত দুই বছর তারা সময় মত বীজতলা করে বোরোর চারা রোপণ করেছেন। এমনকি বোরোর আগেই সেখানে সরিষার আবাদ করেছেন। এবার সেটি না হওয়ার আশঙ্কা করছেন। তবে জমি থেকে দ্রুত পানি নেমে গেলে সেই সুযোগটি পাওয়া যাবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগকে উদ্যোগ নিতে হবে।
মাধনগর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন মৃধা, খাজুরা গ্রামের কৃষক সাদেক আলী ও আচঁড়াখালি গ্রামের কৃষক গোলাম হোসেন সহ আরো অনেকেই জানান, বোরোর বীজতলা তৈরীর আগে বিলের উচুঁ এলাকা বা কান্দি এলাকায় এখন ভরা রবি ফসল সরিষা, গম, কন্দ পেঁয়াজ, ভুট্রাসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদের সময়। অথচ বিল থেকে পানি না নামার কারনে বীজ প্রস্তুত থাকলেও তারা সেসব ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন না। তারা আরো জানান, এখনও পানির নিচে এসব জমি অবস্থান করছে। সময়মত চাষাবাদ শুরু করতে না পারলে এসব বীজ কোনই কাজে আসবে না। এতে তারা রবি ফসল চাষাবাদে উৎসাহ হারাবেন। তাই জরুরী ভিত্তিতে মরা আত্রাই নদী থেকে সোঁতি জাল অপসারন করা জরুরী। তাদের দাবী, মাত্র এক সপ্তাহ সময় নদীতে সোঁতি জাল না থাকলেই হালতিবিলের পানি দ্রুত নিষ্কাষন হবে। একই কথা ও দাবী জানালেন হালতিবিল পাড়ের শতশত কৃষক।
নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস জানান, চলতি মৌসুমের জন্য হালতিবিলসহ আশপাশের এলাকার ৩ হাজার ৭০০ জন কৃষক প্রণোদনার আওতায় সরিষা সহ বিভিন্ন রবি ফসলের বীজ ও সার, ৩ হাজার ৫০০ জন কৃষককে বোরো উফশি বীজ ও সার এবং ৪০০০ জন কৃষককে বোরো হাইব্রিড বীজ দেওয়া হয়েছে। যা সঠিক সময়ে চাষাবাদ করা না গেলে সরকারের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হবে না এবং কৃষকরাও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি বলেন, গত বছর হালতিবিলে ৫২৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের আগেই শুধুমাত্র সরিষা ফসল চাষাবাদ হয়েছে। তার আগের বছর ৪৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা ও বিপুল পরিমাণ অন্যান্য রবি ফসল চাষাবাদ হয়েছে। এবার আরো বেশি পরিমান জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পুরণের জন্যে হালতিবিলের পানি দ্রুত নিষ্কাষণ করা জরুরী। বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) দেওয়ান আকরামুল হক জানান, পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে ইতোমধ্যে হালতিবিলে স্থাপিত বিভিন্ন বাধা ও ত্রিমোহনী এলাকায় সৃষ্ট সোঁতি জাল নলডাঙ্গা উপজেলা প্রশাসনের উদোগে অপসারণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহমুদা খাতুনের সাথে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, মরা আত্রাই নদীতে অবৈধ সোঁতি জাল অপসারন কাজ চলমান আছে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ জানান, কৃষি ও কৃষকের কথা বিবেচনা করে পরিস্থিতি উত্তোরণে কাজ করা হচ্ছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়েছে। আমার জানামতে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সিংড়া উপজেলা প্রশাসনসহ কৃষি বিভাগকে বিষয়টি সুরাহ করার জন্য বলা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, খুব শীঘ্রই সমাধান হয়ে যাবে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মোঃ আবু নাছের ভুঁঞা লিখিত অভিযোগ প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে জানান, অবৈধ সোঁতি জালের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে হালতিবিলসহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা উদচ্ছেদ করা হয়েছে। জনসার্থে কেউ অভিযোগ দিলে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, কৃষি উন্নয়ন ও কৃষকের পাশে জেলা প্রশাসন সব সময় থাকবে।