সঞ্জু রায়, হায়দ্রাবাদ (ভারত) থেকে ফিরেঃ
কয়েক বছর আগে আইআইটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে মেধার লড়াই ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে ভারতের বলিউডে মুক্তি পেয়েছিলো আমির খানের সাড়া জাগানো একটি ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস্’ যে ছবিটি বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল বিশেষ করে প্রকৌশলীদের কাছে। ছবির মূলমন্ত্র ছিলো সফলতার পিছনে না ছুটে নিজেকে যোগ্য করে তোলো তাহলে সফলতা তোমার পিছনেই ছুটবে ঠিক কিছুটা এমনই পন্থায় পাঠদান করে ভারতবর্ষে নির্মিত আইআইটির মাঝে সারাবিশ্বে অন্যতম হয়ে উঠেছে তেলেঙ্গানা রাজ্যের আইআইটি হায়দ্রাবাদ।
এনআইআরএফ র্যাংকিংয়ে ৩য় স্থানে থাকা ভারতবর্ষের কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গণ এই আইআইটি হায়দ্রবাদ যেখানে অধ্যয়নের লক্ষ্যে বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষার্থীরা। আর করবেই বা না কেন কারণ প্রকৃত শিক্ষা অর্জন শুধু নয় প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় গত পাঁচ বছরে স্টার্টআপ থেকে শুধু আয় হয়েছে প্রায় ১২শ কোটি রুপি আর চাকুরির পিছনে এখানকার মেধাবীরা ছোটে না বড় বড় প্রতিষ্ঠান অপেক্ষায় থাকে এই মেধাবীদের স্থান করে দিতে।
আর এমন প্রতিষ্ঠান বন্ধুপ্রতীম দেশ বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও স্থান করে দিতে চান তাদের শিক্ষাঙ্গণে। তাই মাসে ৬০ হাজার রুপি সাথে গবেষণার জন্যে পৃথক ১ লাখ রুপির স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের দাঁড় উন্মোচন করে দিয়েছে আইআইটি হায়দ্রাবাদ। এখন প্রয়োজন শুধুৃ দুই দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সমন্বয় আর একটু সদিচ্ছা তাহলে হয়তো উন্মোচন হবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনার দাঁড়। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে জয়েন্ট ডিগ্রীতেও আগ্রহী ভারতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আইআইটি হায়দ্রাবাদ।
সম্প্রতি আইআইটি হায়দ্রাবাদের সভাকক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ভারত সফররত বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সাথে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষা ও জয়েন্ট ডিগ্রী লাভের সম্ভাবনাময় এই তথ্য দেন আইআইটি হায়দ্রাবাদের পরিচালক সারাবিশ্বে গুণী শিক্ষাবিদের একজন অধ্যাপক বিএস মূর্তি। প্রায় ১ ঘন্টার ঐ সভায় বাংলাদেশি সাংবাদিকদের বিএস মূর্তি জানান, ফার্স্ট স্কিমের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ পিএইচডি করার সুযোগ দিচ্ছেন। ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা টেকনোলজি সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে ভালো ফলাফলসহ মাস্টার্স ডিগ্রী থাকলে শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবেন তবে জিপিএ ১০ এর মধ্যে অন্তত ৮ থাকতে হবে। মূর্তি জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী আছে চার হাজারের বেশি। স্নাতক পর্যায়ে ১৭৬০, স্নাতকোত্তর ১২৮০ ও ডক্টরাল শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে ১১৬০ জন। এখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বায়োমেডিক্যাল, বায়োটেকনোলজি, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্লাইমেট চেঞ্জ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং, মেটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড মেটালজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল আন্ড অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, লিবারেল আর্টস, ডিজাইন, এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ও হেরিটেজ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিসহ নানা সৃজনশীল বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে।
গুণী এই অধ্যাপক জানান, তারা দ্রæত কোর্স শেষ করা আর সনদ প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সমাপ্তিতে বিশ্বস্ত না। আইআইটি হায়দ্রাবাদের মূল লক্ষ্য উদ্ভাবন ও শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ। যদি শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্যে সময় প্রয়োজন পরে তাহলে সেটিই প্রথম গুরুত্ব সেমিস্টার পরীক্ষা পরে। তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী কানো সমস্যা সমাধানে আইডিয়া নিয়ে হাজির হলে সেটা বোর্ডে যায়। বোর্ড পাস করলে শুরুতেই এক লাখ রুপি বৃত্তি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সেই উদ্ভাবন যদি স্টার্টআপ পর্যায়ে যায় তাহলে এই ইনস্টিটিউটই তাকে কোম্পানি পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মূর্তি বলেন, বাংলাদেশি ছাত্রদের এখানে পিএইচডি, ফেলোশিপের মাধ্যমে, আইজিসিসিআর স্কলারপিশের মাধ্যমে এখানে আসতে পারে, ফার্স্ট ফেলোশিপের জন্য আসতে পারে।
সভায় এসময় প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডিন অধ্যাপক তরুণ কান্তি পান্ডা বলেন, তারা চান বেশি বেশি বাংলাদেশি তাদের প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুযোগ পাক। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ না থাকার কথা জানান তিনি। বর্তমানে তাদের যোগাযোগ রয়েছে ছাত্র ও হাতে গোনা গবেষক পর্যায়ে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যদি এগিয়ে আসে তাহলে তারা অবশ্যই সযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। স্কলারশিপে মেধাবীদের সুযোগ প্রদানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে জয়েন্ট ডিগ্রীর ব্যবস্থাও করা যেতে পারে মর্মে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন এই অধ্যাপক।
জানা যায়, আইআইটি হায়দ্রাবাদ এর শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর প্রায় ১০০ টি স্টার্ট আপ দাঁড় করান। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটিতে আফগানিস্তান থেকে আসা শিক্ষার্থী ওয়ারেস আলী উদ্ভাবন করেন চমকপ্রদ এক ডিভাইস যা জানিয়ে দিবে অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসাধীন রোগীর পরবর্তী ৫ মিনিটের পালস রেট। এই ডিভাইসটির সফলতা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এনে দিবে এক নতুন দিগন্ত। শুধু এই উদ্ভাবনই নয় পৃথিবীকে চমকে দেয়া এমন সৃষ্টির লক্ষ্যেই অনেকটাই পথ দেখাচ্ছে আইআইটি হায়দ্রাবাদ।
কথা হয় মাসিক ৬০ হাজার রুপি ও বছরে ১ লাখ রুপির স্কলারশিপে আইআইটি হায়দ্রাবাদে অধ্যয়নের সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশি দুই শিক্ষার্থী চাঁদপুরের আবুল হাসনাত ও সাতক্ষীরাও উৎপলের সাথে। ডুয়েট থেকে বিএসসি সম্পন্ন করা আবুল হাসনাত জানান, আইআইটি হায়দ্রাবাদে পড়তে পারা তার কাছে স্বপ্নের মতো। স্কলারশিপের বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করে আইইএলটিএস বা কোন রকম আলাদা সনদ ছাড়াই শুধুমাত্র অনলাইনে সাক্ষাৎকার দিয়েই তিনি পেয়েছিলেন ভর্তির সুযোগ। বর্তমানে স্বস্ত্রীক প্রতিষ্ঠানটিতে থেকে গবেষণা করছেন মেধাবী হাসনাত যার স্বপ্ন এখন আকাশ ছোঁয়ার। হাসানাতের মতো বাংলাদেশ থেকে আসা আরেক শিক্ষার্থী উৎপল কুমার ঘোষের গল্পও কিছুটা এইরকমই। দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে এসে মেধার আলোয় এখন নিজেকে সাফল্যের সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে সে। তিনি বলেন, শুধু আমরা ২ জন কেন আমরা চাই বাংলাদেশের শত শত শিক্ষার্থী আসুক ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানে যার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারকে আইআইটি হায়দ্রাবাদের কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয়ের অনুরোধও জানান উৎপল। ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের সাঙ্গারেডি জেলার কান্দি গ্রামে প্রায় ৬০০ একর জায়গার উপরে গড়ে উঠা সরকারি এই প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশী মেধাবী শিক্ষার্থীদের অন্যতম গন্তব্যস্থল অপেক্ষা শুধু সমন্বয়ের।
ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি প্রেস অফিসার শিলাদিত্য হালদারের নেতৃত্বে ভারত সফররত বাংলাদেশী সাংবাদিকদের মাঝে এসময় ছিলেন জনকণ্ঠের সম্পাদক ওবায়দুল কবির মোল্লা, ডিবিসি নিউজের প্রণব সাহা, মাছরাঙা টিভির রেজওয়ানুল হক রাজা, একাত্তর টিভির শাকিল আহমেদ, নিউজ২৪ টিভির রাহুল রাহা, দিপক আচার্য্য, বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাজী শাহেদ, সময় টিভির রাফি সাদনান আদিল, যুগান্তরের শিপন হাবিব, দেশ টিভি ও দৈনিক চাঁদনী বাজারের রিপোর্টার সঞ্জু রায়, জাগো নিউজের আসিফ আজিজসহ মোট ২৮ জনের প্রতিনিধি দল।