কারুশিল্পের গ্রাম হায়দ্রাবাদের শিল্পারামামঃ ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিকশিত করছে গ্রামীণ এই জাদুঘর

সঞ্জু রায়, হায়দ্রাবাদ (ভারত) থেকে ফিরেঃ কথায় আছে ‘যা নেই জগতে তা আছে ভারতে’ প্রকৃত অর্থেই দেশটির বিভিন্ন রাজ্য আর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মাঝে খোঁজ মেলে কালের ক্রমে চলে আসা নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির। দেশটি জানে কিভাবে তাদের সংস্কৃতি ও শিল্পকে বয়ে নিয়ে চলতে হয় যুগের পর যুগ যার দরুন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এখন পরিণত হয়েছে এক একটি পর্যটন কেন্দ্রে যেখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কারণ জানার যে ক্ষুধা তা সর্বদা সকল কিছুর উর্ধ্বে। এমনই এক পর্যটন কেন্দ্র ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দ্রাবাদ শহরের শিল্পারামাম যা কারুশিল্পের গ্রাম কিংবা ভিলেজ মিউজিয়াম বা জাদুঘর নামেও পরিচিত।
হায়দ্রাবাদ শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ১৯৯২ প্রতিষ্ঠা এই গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকার। ভারতীয় শিল্প ও কারুশিল্পের প্রচার ও প্রসার এবং কারিগরদের অনুপ্রাণিত করতে এটি গড়ে তোলা হয়। যা পর্যটকদের জানাচ্ছেন ভারতীয় শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে এবং পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। ভারতের হাই-টেক হাব শহরে ৬৫ একর জমির উপর বিস্তৃত শিল্পারামাম শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক মনোরম পরিবেশ দেয়। এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বের হতে পাওয়া যাবে ভারতীয় শিল্প, কারুশিল্প ও গ্রামীণ জীবনের পুরো আবেশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের ভারত সফরের অংশ হিসেবে এই মনোমুগ্ধকর স্থানটি পরিদর্শনকালে সকলেই বিস্মিত হয়েছে এই স্থানের সৌন্দর্য ও প্রাণবন্ত পরিবেশের ছোঁয়ায়। পরিদর্শনের দিনটিতে শিল্পারামামে চলছিল দক্ষিণীদের ‘বাথুকাম্মা উৎসব’ যা শারদীয় দুর্গাপূজা বা দশেরা উৎসবকে ঘিরে মহালয়া থেকে শুরু হয়। পুরো স্থান জুড়ে যেন উৎসবের আমেজ কেউ খেলছে, কেউ গাইছে আবার কেউ বা প্রাণ খুলে নাচছে মনে হবে পৃথিবীতে যেন কোন দুশ্চিন্তা নেই আছে শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম আর নিজেদের অন্তরে অনন্ত প্রশান্তি। দেশ-বিদেশ থেকে আসা শত শত পর্যটক উপভোগ করছে এই অঞ্চলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের শাস্ত্রীয় নৃত্যকলা যা সকলকে অবাক করে দিবে মূহুর্তেই কি মেধা আর দক্ষতা শিশুগুলোর। ঘন্টার পর ঘন্টা কিভাবে কেটে যাবে বুঝতেই পারেনা পর্যটকরা।
বড়রা ৬০ রুপি ও ছোটরা ২০ রুপি দিয়ে প্রবেশের পর এই স্থানটিতে কেনাকাটাসহ করতে পারেন ইচ্ছা অনুযায়ী প্রায় সকল কিছুই। শিল্পারামামে রয়েছে ৩৫০টি স্থায়ী ও ৯০টি অস্থায়ী স্টল যেখানে স্থান পেয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কারুশিল্পের পণ্য তবে নারী পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের এই স্থানে মেলা কাঞ্জিভরম, গাদোয়াল কিংবা কলমকারির কাজের শাড়ি কিংবা থ্রি পিস সাথে গুজরাটি লেহেঙ্গারও বাহারি পশরা চোখে পরে এখানে। তবে পুরুষদের জন্যেও রয়েছে সম্পূর্ণ হাতে কাজ করা ফতুয়া, পাঞ্জাবি কিংবা শার্ট রয়েছে ছোটদেরও ননা বাহারি পোষাক। আর বিভিন্ন স্টলে থাকা বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্যগুলো বেশ আভিজাত্যপূর্ণ। তালপাতায় আঁকা ক্ল্যাসিকাল শিল্পকর্ম বহন করে বিশেষত্ব।
কথা হয় হায়দ্রাবাদ শহর থেকে ১০০ কিমি দূর থেকে এই্ স্থানে ব্যবসা করতে আসা বিজয় রেড্ডি নামের এক দোকানির সাথে। তিনি বলেন, এই স্থানে আলাদা একটা প্রশান্তি পাওয়া যায়। দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো পর্যটক আসে শিল্পাপারামামে শুধু ভারতের সংস্কৃতিকে খোঁজ করতে আর আমরাও সুযোগ পায় অতিথি আপ্যায়ণ ও তাদের সাদরে বরণ করতে। এই স্থানটির কারণে তার মতো শত শত মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে।
দিল্লী থেকে ঘুরতে আসা দুই শিক্ষার্থী সোনাল ও বিজয় এর সাথে কথা হলে তারা জানান, তারা এতদিন ইউটিউব ও অনলাইনে শিল্পারামাম এর নানা গল্প শুনেছে এবং ভার্চুয়ালি দেখেছে কিন্তু আজ সামনা সামনি দেখে মুগ্ধ হয়েছে তারা। গতানুগতিক জাদুঘরের মতো নয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাদরে মুড়িয়ে স্থানটিকে সাজানো হয়েছে গ্রামীন এক মুক্ত জাদুঘরের রুপে। যেখানে একবার ঘুরলেই অতীত বাংলার সকল ইতিহাস ভেসে উঠে। কামার, কুমার, জেলে, কৃষক, তাঁতি থেকে শুরু করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার যে চিত্র ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে তা কৃত্রিম হলেও প্রথম দেখায় তা বোঝার উপায় নেই।
ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকারের তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের যুগ্ম পরিচালক এন ভেঙ্কাটেশওয়ারা রাও স্থানটি সম্পর্কে বলেন, ধীরে ধীরে ভারত ছাড়িয়ে শিল্পারামামের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে।  প্রতিদিনই বাড়ছে পর্যটক। ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির প্রচার ও সংরক্ষণে সরকার এই স্থানটিকে এভাবে সাজিয়েছেন জানিয়ে বিশ^বাসীকে শিল্পারামামে সাদরে আমন্ত্রণ তিনি।
আইটি সিটি হিসেবে এতদিন পর্যটকরা হায়দ্রাবাদ কে চিনলেও শহরটিতে লুকিয়ে আছে নানা ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নানা অজানা প্রশ্নের উত্তর। তাইতো কোন পর্যটক একবার হায়দ্রাবাদ গেলে শিল্পারামাম এর মতো এমন অনেক স্থানই আকৃষ্ট করবে নিজের কাছে।  

লেখক, সাংবাদিক

সঞ্জু রায়