বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই) এর ২০১৭ সালে প্রকাশিত গেøাবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ২৯ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এ রিপোর্ট অনুযায়ী পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে কমনওয়েল্থ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে কোনো তথ্যব্যবস্থা না থাকায় এর প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনার বিশ্লেষণ:
গ্লোবাল
হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগ
বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনা থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর
তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। সাধারণত পানিতে ডুবে মৃত্যুর সবগুলো ঘটনা
গণমাধ্যমে উঠে আসে না। এখানে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রাপ্ত প্রবণতাগুলো
উপস্থাপন করা হয়েছে।
সংবাদপত্রে মোট ঘটনা ও মৃত্যু
জাতীয়
পর্যায়ের গণমাধ্যম ও স্থানীয় পর্যায়ের অনলাইন নিউজ পোর্টালে ২০২০ সালের
পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৫৭৯টি ঘটনার কথা প্রকাশিত
হয়েছে। এসব ঘটনায় সারাদেশে ৮০৮ শিশুসহ মোট ৯৬৮ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে
মারা যায়।
কোথায় কত মৃত্যু
পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটনা ঘটে
ঢাকা বিভাগে, ২১১ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ১৮৪ জন, রংপুরে ১৪৩, রাজশাহীতে ১২১,
ময়মনসিংহে ১০৬, বরিশালে ৮৩ ও খুলনা বিভাগে ৭২ জন মারা যায়। এ সময়ে সবচেয়ে
কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে, ৪৮ জন।
নেত্রকোনা জেলায় গত ১৫ মাসে সবচেয়ে
বেশি মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, ৫১ জন। পরবর্তী স্থানগুলোতে রয়েছে
কুড়িগ্রাম, ঢাকা, নোয়াখালী, দিনাজপুর ও গাজীপুর জেলা। এসব জেলায় যথাক্রমে
৪৬, ৪৬, ৩৩, ৩৩ ও ২৮ জন মারা যায়। বান্দরান, শরীয়তপুর ও নড়াইল Ñ এ তিনটি
জেলায় কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
বয়স
পানিতে ডুবে মৃতদের
৮৩ শতাংশই শিশু। চার বছর বা কম বয়সী ৩৪৮ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩০৮ জন,
৯-১৪ বছরের ১২০ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৩২ জন। ১৬০ জনের বয়স ১৮ বছরের বেশি।
একাধিক স্বজন হারিয়েছে ৭০ পরিবার
এ
সময়ে ৭০টি পরিবারের ১৮৪ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের মধ্যে শিশুর
সঙ্গে ভাই অথবা বোনসহ ৬৮ জন, বাবা-মাসহ ১৯ জন, দাদা-দাদি বা নানা-নানিসহ ৪
জন, চাচাত বা খালাতো ভাই বা বোনসহ ৮১ জন, চাচা-খালাসহ ১৩ জন মারা যায়।
জেন্ডার
পানিতে
ডুবে নিহতদের মধ্যে ৩৫২ জন নারী। এদের মধ্যে কন্যা শিশু ৩১৯ জন। পুরুষ
মারা যায় ৬১০ জন, যাদের মধ্যে ৪৮৩ জন শিশু। প্রকাশিত সংবাদ থেকে ছয় জনের
লৈঙ্গিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দিনের কখন পানিতে ডুবছে
দিনের
প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৩৯৪ জন এবং দুপুর থেকে
সন্ধ্যার আগে ৩৮৮ জন মারা যায়। এছাড়া সন্ধ্যায় ১৫৪ জন মারা যায়। ২০ জন
রাতের বেলায় পানিতে ডোবে। ১২ জনের মৃত্যুর সময় প্রকাশিত সংবাদ থেকে নিশ্চিত
হয় যায়নি।
কোন মাসে বেশি মৃত্যু
গত ১৫ মাসে ২০২০ সালের জুন
থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে সর্র্বোচ্চ সংখ্যক ৫৭৭ জন মানুষ পানিতে ডুবে
মারা যায়। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে আগস্ট মাসে, ১৭১ জন। জুন মাসে ৯১ জন,
জুলাই মাসে ১৬৩ জন। ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে ৫৯ জনের মৃত্যুর বিপরীতে
২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে মৃত্যুবরন করে ১৫৮ জন, যা গত বছরের তুলনায় ১৬৮
শতাংশ বেশি। এক্ষেত্রে ধারনা করা যায় যে, প্রকৃত অর্থেই মৃত্যুর সংখ্যা
বৃদ্ধি পেয়েছে অথবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ গতবছরের তুলনায় বৃদ্ধি
পেয়েছে।
কারণ
৭৮৩ জন কোনো না কোনো ভাবে পানির সংস্পর্শে এসে
ডুবে যায়। ১১৮ জন মারা যায় নৌযান দুর্ঘটনায়। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে পানিতে
ডুবে মৃতদের মধ্যে ৫৫ জন বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে।
পরিবারের
সদস্যদের যথাযথ নজরাদারি না থাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পানিতে ডোবার ঘটনা
ঘটে। অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে চলে যায়
এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়।
নৌযান দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ২০২০ এর
২৯ জুন। বুড়িগঙ্গা নদীতে এমএল মর্নিং বার্ড নামের একটি লঞ্চ ময়ূর-২ নামের
আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায়। এতে ৩২ জন মারা যায়। ৫ আগস্ট
নেত্রকোনার মদন উপজেলায় হাওরে নৌকা ডুবে ১৭ জন মারা যায়।
সুপারিশ
বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রিভেন্টিং ড্রাওনিং: অ্যান
ইমপ্লিমেন্টেশন গাইডে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষজনকে সম্পৃক্ত করে দিবাযতœ
কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। এছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে
পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি ও জাতীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করার উপরও
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সুপারিশ করেছে।