মমতাজ বেওয়া। বয়স ৬৩ এর কোঠায়। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগরের চাঁইপাড়ার মৃত রওশন সরকারের মেয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরপরই তার বিয়ে হয়েছিল একই গ্রামের মোজাম্মেল হকের সাথে। দুই মেয়ে আর এক ছেলের জন্মের পর মোজাম্মেল হক পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেন। বিছানাগ্রস্থ স্বামী আর তিন সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যান মমতাজ। অভাবের তাড়নায় মমতাজ ঝি’য়ের কাজ করে সংসার চালানোর পাশাপাশি অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করেন। এভাবেই চলতো তাদের সংসার। এরপর মেয়েরা বড় হলে তাদের বিয়ে দেন। আর ছেলে বিয়ে করে বউকে নিয়ে আলাদা থাকেন। রিক্সা চালিয়ে সংসার চালানো ছেলের ওপরেও মা মমতাজ বোঝা হতে চাননি। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে অন্যের জমিতে কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন। অবশেষে বছর তিনেক পূর্বে মমতাজের স্বামী মোজাম্মেল হক মারা যান। এরপর একাকিত্ব জীবন থেকে কিছুটা স্বস্থির আশায় বিধবা বৃদ্ধা মায়ের কাছে চলে যান মমতাজ বেওয়া। মামার জমিতে ছোট্ট কুড়ে ঘরে এখন বৃদ্ধ মায়ের সাথেই থাকেন তিনি।
শনিবার কথা হয় মমতাজ বেওয়ার সাথে। তিনি জানালেন, ১৯৯০-৯১ সালে সরকার তার আবেদনে সাড়া দিয়ে নিজের ইউনিয়নের জামনগর মৌজায় এক একর ৩৭ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে তাকে দলিল করে দেয়। প্রভাবশালীদের চাপ আর নিজের অভাব অনটন এবং অক্ষরজ্ঞান না থাকায় সে জমির কোন ব্যবহার তিনি আজও করতে পারেননি। এরইমধ্যে তার পার্শ্ববর্তী গ্রামের ঝুরমান বেওয়া ওরফে ঝুড়নের প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমিদানের খবর জানতে পারেন। শেষ বয়সে তাই তারও ইচ্ছে হয় সরকারের দেয়া তার জমি থেকে ৭১ শতাংশ জমি প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে দান করার। যেন তার মতো গৃহহীন আরো অনেক পরিবার একটু মাথা গোঁজার ঠাই পায়, ঠিকানা পায়। এরপর জামনগর ভূমিহীন সমিতির সাধারন সম্পাদক মোত্তালেবের মাধ্যমে ইউএনও প্রিয়াংকা দেবী পালের সাথে যোগাযোগ করে তার ইচ্ছের কথা জানান। অবশেষে শনিবার উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে উন্নয়ন মেলায় এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় দলিলে মমতাজ বেওয়া সাক্ষর করেন এবং তা ইউএনও প্রিয়াংকা দেবী পালের হাতে হস্তান্তর করেন। পেড়াবাড়িয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত উন্নয়ন মেলায় উপজেলা ভূমি অফিসের নামে বরাদ্দ স্টলেই তিনি এসব কাগজপত্র হস্তান্তর করেন। এসময় সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম গকুল, সহকারি কমিশনার (ভূমি) নিশাত আনজুম অনন্যাসহ তিন ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। দলিল হস্তান্তর শেষে তাৎক্ষনিকভাবে মমতাজ বেওয়া সাংবাদিকদের কাছে তার ইচ্ছে পুরণের অভিব্যক্তি তুলে ধরে বলেন, তিনি নিজে ভূমিহীন। তিনি জানেন ভূমিহীন ও গৃহহীনদের সমস্যা। তার জমিতে ভূমিহীন ও গৃহহীনরা আশ্রয় পাবে এতে তিনি বেজায় খুশি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন, মমতাজ বেওয়ার এই অবদান দেশ প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর আগে একই উপজেলার ঝুড়ন বেওয়া ৮০ শতাংশ জমিদান করেছেন। ঝুড়নকে সরকারিভাবে একটি বাড়ি উপহার দেয়া হয়েছে। দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এই ঘোষনার বাস্তবায়নে মমতাজ বেওয়াকেও প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে একটি গৃহ প্রদান করার ঘোষনা দেন তিনি। একই সাথে প্রভাবশালীদের কাছে থাকা মমতাজ বেওয়ার বাঁকি জমিও উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের কথা জানান ইউএনও।
এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম গকুল বলেন, নিজে গৃহহীন হয়েও দেশের জন্য গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণে জমি দান করে মমতাজ বেওয়া জাতীয় বীরের কাজ করেছেন।