মা-বাবা চাকুরী করে ঢাকা গার্মেন্টেস্ এ তাই দাদা-দাদি আর ফুফুদের সাথে ৮ বছরের শিশু মাহি উম্মে তাবাস্সুম যাচ্ছিল নিজ গ্রামেই অনুষ্ঠিত ইসলামী জলসাতে। যাওয়ার সময় তার পায়ে দেওয়ার জুতা ছিলনা বলে রওনা হয়েছিল তার বাবার জুতা পরেই আর ফোনে বাবাকে বলছিল ‘যে বাবা আমার তো জুতা নেই, আমি কিন্তু তোমার জুতা পরে জলসায় যাচ্ছি তুমি ঢাকা থেকে আসার সময় আমার জন্যে জুতা নিয়ে এসো’। ঢাকা গার্মেন্টেসে চাকুরী করা বাবা ঠিকই ফিরলো কিন্তু দেখতে পেলো গণধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়া তার ছোট্ট দুধের শিশু তাবাস্সুমের নিথর দেহ।
গত ১৪ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার ধুনট নশরতপুর এলাকায় মাহফিল থেকে ডেকে নিয়ে ৮ বছরের শিশু মাহি উম্মে তাবাসসুম কে ধর্ষণের পর হত্যার ১১ দিনের মাথাতেই মূল রহস্য উন্মোচন করেছে বগুড়া জেলা পুলিশ। শনিবার সকালে বগুড়া পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে উক্ত ক্লু-লেস ঘটনার এক লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদাড়ক ঘটনার বর্ণনা দেন জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম (বার)। তিনি বলেন, এই অমানবিক ঘটনার সাথে জড়িত প্রধান ৪ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, তোজাম্মেল হকের ছেলে বাপ্পি আহম্মেদ (২২) যে স্থানীয় জিএমসি ডিগ্রী কলেজের বিএ ২য় বর্ষের ছাত্র, দলিল উদ্দিন তালুকদারের ছেলে মুদি দোকানদার কামাল পাশা (৩৫), সানোয়ার হোসেনের ছেলে রাজমিস্ত্রী শামীম রেজা (২২) এবং মৃত সাহেব আলীর ছেলে রংমিস্ত্রী লাবলু শেখ (২১) যারা প্রত্যেকেই বগুড়ার ধুনট নশরতপুর গ্রামের। পুলিশ সুপার জানান, ১ নং আসামী বাপ্পীর চাচার সাথে নিহত শিশুর বাবা বেলাল হোসেন খোকনের পরিবারের পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে ঘটনার প্রায় ৩ মাস পূর্বেই শিশু তাবাস্সুম কে হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধের পরিকল্পনা করেছিল আসামীরা। ঘটনার দিন সকালেও এলাকার হাজী কাজেম জুবেদা টেকনিক্যাল এন্ড বিএম কলেজের মাঠেও আসামীরা সকলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করেছিল। এরপর ঐদিন রাতেই ছোট্ট শিশু তাবাস্সুম তার দাদা-দাদী আর দুই ফুফুর সাথে জলসায় যায়। জলসার কোন এক ফাঁকে তাবাস্সুম অন্য শিশুদের সাথে বেলুনের দোকানে গেলে বাদাম কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আসামীরা কৌশলে তাবাস্সুম কে সেই কলেজের মাঠে নিয়ে যায় এবং তার মুখ চিপে ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পালাক্রমে ধর্ষণের ফলে একপর্যায়ে ছোট্ট শিশুটি নিস্তেজ হয়ে পড়লে তাকে অবশেষে গলা টিপে হত্যা নিশ্চিত করে আসামী বাপ্পী। এতেই শেষ নয় হত্যার পর কাটিং প্লাস দিয়ে আসামীরা সেই শিশুর হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল যেন সকলে বোঝে যে তাকে কোন জন্তু কামড় দিয়ে মেরে ফেলেছে। এরপর তাবাস্সুমের দেহ কাঁধে তুলে নিয়ে আসামী বাপ্পী পাশেই বাদশার বাঁশ ঝাড়ে ফেলে রেখে যায় যেন এই ঘটনার জন্যে বাদশার ছেলেকে সবাই সন্দেহ করে। এরপর বাপ্পী বাড়িতে চলে যায় এবং বাকি ৩ জন সেই জলসায় সেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। এদিকে রাত হয়ে গেলেও শিশু তাবাস্সুম ফিরে না আসলে তাকে তার দাদা-দাদী, ফুফুরা খুঁজতে শুরু করে পরে আনুমানিক রাত দেড়টায় বাঁশঝাড়ের ভিতর এলাকাবাসী সেই শিশুকে দেখতে পায়। তখনও মৃত তাবাস্সুমের যৌনাঙ্গ দিয়ে রক্ত ঝড়ছিল এবং তার বুকে ও গালে ছিল কামড়ের দাগ। স্থানীয় লোকজন তৎক্ষনাৎ তাকে ধুনট স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রেস ব্রিফিং এ এসপি আলী আশরাফ আরো বলেন, ঘটনার পরেরদিন নিহত শিশুর বাবা বেলাল হোসেন খোকন বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(২) ধারায় মামলা দায়ের করেন। সাথে সাথেই তার নির্দেশে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুর রশিদের তত্বাবধানে এবং শেরপুর-ধুনট সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমানের নেতৃত্বে ধুনটের ওসি কৃপা সিন্ধু বালা, এসআই রিপন মিঞা, এএসআই আতিকসহ একটি পুলিশের একটি চৌকস টিমের অভিযানে ১১ দিনের মাথায় শুক্রবার সন্ধ্যায় সকল আসামীদের গ্রেফতার এবং তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উক্ত ঘটনার রহস্য উন্মোচন সম্ভব হয়েছে।
এদিকে আসামীদের শনিবার দুপুরের পর আদালতে প্রেরণ করে ৮দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে মর্মে নিশ্চিত করেছেন প্রেস ব্রিফিং এ উপস্থিত থাকা জেলা পুলিশের মিডিয়া মুখপাত্র সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ। অপরদিকে শনিবার প্রেস ব্রিফিং চলাকালেই নিহত শিশুর মা-বাবার বুকফাটা আর্তনাদ আর না থামা চোখের জোলে স্তভিত হয়ে গিয়েছিল বগুড়া পুলিশ সুপারের কার্যালয়। বিয়ের অনেক বছরের অপেক্ষায় জন্ম নেয়া একমাত্র কণ্যা তাবাস্সুমকে আর কখনো ফিরে না পেলেও আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি জানিয়েছে নিহতের বাবা-মাসহ তার পরিবার।