মারণ ব্যাধি বৈশি^ক করোনা ভাইরাস গোটা বিশ^বাসীর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি মানুষের জীবনই তছনছ করে ফেলেছে। বিগত জানুয়ারি মাসে চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস গোটা বিশে^র মানুষের নিকট জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে। কতদিন বাদে এর অবসান হবে বা আদৌ হবে কিনা তা কেউই নিশ্চয় করে বলতে পারেনা। দেখতে দেখতে এপর্যন্ত অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর-২০২০তারিখ পর্যন্ত সারা বিশে^ ১০ লাখ ৬ হাজার ৯০৫ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৭৬ হাজার ৪৬৪ জন। আক্রান্তের অনুপাতে সুস্থ্যের সংখ্যা ২ কোটি ৪৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪৬৬ জন।বাংলাদেশে চলতি ২০২০ সালের মার্চ মাসের ৮ তারিখে প্রথম করোনা সনাক্ত হয়। এপর্যন্ত অর্থাৎ ২০৬ তম দিনে করেনা ৫ হাজার ২১৯ জনের প্রাণ হরণ করেছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৪৩ জন। সুস্থ্য হয়েছেন ২ লাখ ৭৩ হাজার ৬৯৮ জন।
এরই মাঝে দ্বিতীয় ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। এবিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি অতি সম্প্রতি একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে; প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বৈদেশিক যোগাযোগ উন্মুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিধি মানার ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরণের শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে বাংলাদেশেও পুনরায় সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয় দফা সংক্রমণের পাশাপাশি সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে পরামর্শক কমিটি।
এছাড়া দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ দ্রুত নির্ণয় করার জন্য ও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যে হেতু জীবিকার স্বার্থে লকডাউন সম্ভব নয়, তাই একটি কার্যকর টিকা না পাওয়া পর্যন্ত নিরাপদ থাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা, সাবান দিয়ে বার বার হাত ধোওয়া এবং সামাজিক দুরত্ব মেনে চলাই কোভিড-১৯ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় বলে মন্তব্য করেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এই কমিটি। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য আরো বেশি করে টেষ্ট করা প্রয়োজন বলে মনে করছে পরামর্শক কমিটি। এছাড়া জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় এক্স-রে, রক্তের কিছু পরীক্ষার সম্প্রসারণ করা জরুরি বলে মত দিয়েছে।
কমিটি বলছে, কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সংক্রমিত ব্যক্তিকে দ্রুত চিহ্নিত করে আইসোলেট করতে হবে। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্কিনিং, কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করাসহ প্রবেশ পয়েন্টে প্রতিরোধ কার্যক্রম আরো জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছে পরামর্শক কমিটি। হাসপাতালে যে স্বাস্থ্য কর্মীরা কাজ করছেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নিয়েও সভায় আলোচনা করা হয়েছে। কারণ স্বাস্থ্য কর্মীদের পাশাপাশি তাদের পরিবার-পরিজনও কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে। সেই সঙ্গে রোগীদের তথ্য বিনিময় করার জন্য আন্তঃ হাসপাতাল রেফারেল নেটওয়ার্ক তৈরি করার জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পরামর্শক কমিটি মনে করে, সংক্রমণের হার নিম্নমুখি হলেও এখনো হার স্বস্তিকর পর্যায়ে যায়নি। তাই হাসপাতালে কোভিড-১৯ শয্যা সংকোচন করা হলেও পুরোপুরি বন্ধ না করে ভবিষ্যতে যাতে পুনরায় ব্যবহার করা যায়, সেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছে।
তবে বাংলাদেশে এখনো সংক্রমণের প্রথম ঢেউ বিলীন হয়নি, বরং সনাক্ত সংখ্যা কমেছে ধীর গতিতে। ফলে প্রথম ঢেউ কোথায় গিয়ে কবে শেষ হবে সেটা নিয়ে সংশয় কাটছেনা। এর মধ্যেই উদ্বেগ শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে।
এবিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন,‘ দেশে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। তবে দ্বিতীয় ধাক্কা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগ প্রস্তুত রয়েছে বলে তিনি জানান। গত ২৩ সেপ্টেম্বর মুজিব বর্ষ উপলক্ষ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আধুনিকায়ন, উন্নত মানের চিকিৎসা সেবা এবং শিক্ষার সম্প্রসারণমূলক কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলায় উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলায় চিকিৎসক নার্সসহ স্বাস্থ্য বিভাগ প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন, শীতকালে বিয়ে ও পিকনিকসহ নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। জনসমাগম বেশি হওয়ায় করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে এসব অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকতে হবে। এসময় স্বাস্থ্য মন্ত্রী জনগণকে করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা ও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
আসন্ন শীতকালে বাংলাদেশে কোভিড- ১৯ আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষকে প্রশিক্ষত করা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলতে উৎসাহ দেয়া, পর্যাপ্ত পরীক্ষা নিশ্চিত করা ও বিদেশ থেকে আগতদের কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। পাশাপাশি তারা বলছেন কোভিডের প্রথম ঢেউ থেকে শিক্ষা নিয়ে ও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে একটি রোড ম্যাপ তৈরি এবং কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে শীতকালীন সম্ভাব্য ঢেউ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে আক্রান্তদের সঠিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যায়।
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ এটা ধারণা করা হয় যে, ইউরোপের কয়েকটি দেশের মত শীতের সময় আমাদের দেশেও করোনা কিছুটা তীব্র আকার ধারণ করতে পার্।ে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, সম্প্রতি স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি ও নির্দেশনা মেনে চলার বিষয়ে অনীহা মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে ওঠায় প্রধানমন্ত্রী জনগণকে সচেতন করা বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করেছেন।
জাতীয় কারিগরি কমিটির ( এনটিএসি) সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারকে কিছু বৈজ্ঞানিক অনুমানের ওপর ভিত্তি করে পরিস্থিতি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত’’। । (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।
এবাদত আলী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সদস্য পাবনা প্রেসক্লাব।