‘‘বঙ্গবন্ধু না থাকলে
এদেশ হতো কাশ্মির বা ফিলিস্তিন,
তাইতো জাতির জনকের কাছে
এ জাতির রয়েছে অনেক ঋণ।’’ কবি মোঃ আলমগীর হোসেনের কবিতার চারটি পংতি। যা প্রকাশিত হয়েছে গত ১৩ আগস্ট অন লাইন পত্রিকা ‘ অনাবিল ডট নেট’ এ।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্যি সত্যিই এদেশের মানুষকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে গেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এবছরের গোড়ার দিকে তৎকালিন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ কায় মন বাক্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থাশীল হয়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের বেলা বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নীরিহ বাঙালিদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে বসে। তারা নির্বিচারে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। বাংলার অকুতভয় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর,আনসার এবং এদেশের তরুণ সমাজ পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশকে শত্রæমুক্ত করতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস একটানা যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয় বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য।
বাংলাদেশের এই স্বাধীনতার স্থপতি বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। দেশ স্বাধীন হলো অথচ স্বাধীনতার স্থপতি দেশে ফিরে এলেন না এটা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে অসহ্য বেদনাদায়ক। তাই সবার কন্ঠই সোচ্চারিত হয়ে উঠলো ‘আমরা আমাদের প্রানপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত চাই। স্বাধীন বাংলার সকলেই তাঁর মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দো‘য়া প্রার্থনা করতে লাগলো। বাংলার মা-বোনেরা তাঁর মুক্তি ও সুস্থ্যতা কামনায় নফল রোজা পালন করলো। দেশের হিন্দুসহ অন্যান্যরা নিজ নিজ উপসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনায় মিলিত হলো।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বাঙালি জাতির নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তিলাভ করে প্রথমে লন্ডন ও পরে দিল্লী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করলেন। বাংলার ঘরে ঘরে সেদিন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। বাংলার জনগণ তাঁকে এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। বাংলার মানুষ মহা খুশিতে তাঁকে বরণ করে নিলো। অথচ মাত্র সাড়ে ৩বছর যেতে না যেতেই সেই রাষ্ট্রনায়ককে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। সেই সাথে তাঁর নিকট আত্মীয় স্বজনকেও হত্যা করা হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ভোরবেলা সু-পরিকল্পিতভাবে পৈশাচিক এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহনকারী মানুষটিকে সাড়ে তিনবছর আগে সিংহাসনে বসানো হলো ; অথচ তাঁর মৃত্যু সংবাদে করা গেলনা কোন প্রতিবাদ। অনুষ্ঠিত হলোনা কোন মিটিং মিছিল কিংবা শোকসভা। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানকারি বাংলার নয়নমনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন কি অপরাধ করেছিলেন যে, তাঁকে এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে অকাতরে জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হলো? শুধু কি তাই হত্যা করার পর তার লাশের প্রতিও অমর্যাদা করা হয়।
বর্তমানে বৈশি^ক করোনাকালে মানুষ মৃত্যবরণ করলে অদৃশ্য শত্রæ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে সে লাশের নিকট কেউ যেতে চায়না। হাসপাতাল মর্গে কিংবা রাস্তা পথে মরদেহ পড়ে থাকলেও অতি প্রিয়জনেরা লাশের দিকে ভুলেও ফিরে তাকায়না। মানুষ এমন পাষান হৃদয়ের হতে পারে। ভাবতেই কষ্ট হয়।
তখন ঘাতকদের নিকট বৈশি^ক করোনা ভয় ছিলোনা বটে কিন্তু তার চেয়েও অতি ভয়ংকর ছিলো জনরোষের ভয়। কিন্তু কোথায় গেলো সে জনরোষ? যে সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মি বঙ্গবন্ধুর চারপাশে ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়াতেন তারাই বা কোথায় ছিলেন। কোথায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা? যারা বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যাদের সংখ্যা বর্তমানে গেজেট ভুক্তি অনুসারে ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৪৯ জন। বঙ্গবন্ধু এমন কি অপরাধ করেছিলেন যে, তাকে সপরিবারে হত্যা করার পর তখনকার রাজনৈতিক নেতা, যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, সর্বপোরি কৃষক শ্রমিক মেহেনতি মানুষের ভুমিকাই বা কি ছিলো? তাকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।
তবে সারা দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভুলে গেলেও নিজ এলাকা টুঙ্গিপাড়ার মানুষ সেদিন ১৬ আগষ্ট করোনাকালের মরণ ভীতির মত তার মরদেহ ফেলে দেয়নি। বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র হতে জানা যায় তারা সেদিন ঘাতকের গুলিতে ঝাঁঝরা বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ মায়া-মমতা দিয়ে ইসলামি শরাহ- শরিয়ত মোতাবেক তাঁর নিজস্ব ভুমি টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করতে উন্মুখ হয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়া ও আশেপাশের হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর মরদেহ নিয়ে আসার খবর পেয়ে টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে জড়ো হওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করেন। কিন্তু হেলিকপ্টারে মরদেহ আনার আগ মূহুর্তে সেখান থেকে সকল মানুষকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র ৩০/৩৫ জনকে হেলিকপ্টার থেকে মরদেহ নামিয়ে কবর দিবার জন্য অনুমতি দেয় ঘাতকেরা।
ঘাতকেরা কাঠের কফিনসহই কোনমতে কবরে নামিয়ে সটকে পড়তে চেয়েছিলো। কিন্তু মরদেহ নামানো এবং কবরস্থানে নিয়ে আসার অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিদের চাপের কারণে কফিন খুলে ধর্মীয় রীতি মাফিক গোসল ও জানাজা পড়াতে রাজি হয়। তাদেরকে মাত্র ১৫/২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়। মিস্ত্রি ডেকে কাঠের বাক্স খোলা হয়। পাশের দোকান থেকে ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করানো ও রেডক্রসের রিলিফের শাড়ি কাপড় দিয়ে কাফনের কাপড় বানিয়ে সামান্য কয়েকজন ব্যক্তি মিলে জানাজা পড়িয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বাধীন বাংলার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার পিতা-মাতার কবরের পাশে দাফন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বলে বিচারের পথও বন্ধ করে দেয় এবং খুনিদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের যাবতীয় সুযোগের পথ সুগম করা হয়। । বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। এদিকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সমপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার মানুষের অকুন্ঠ সমর্থনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের হয়ে সরকার গঠন করেন। এবছর ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে উক্ত ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ শুরু করেন। বিচারে আত্মস্বীকৃত খুনিদের মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যদন্ড কার্যকর করা হয়। বাকি ৫ জন খুনি এখনো বিদেশের মাটিতে পলাতক। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করার দাবিসহ বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে আর কারা জড়িত? সেই সব কুশিলবদের বিচারের জন্য একটি কমিশন গঠনের জন্য বর্তমান সরকারের কাছে দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে যেভাবে সুনামের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছেন, তার সরকার এই দাবির প্রতি নিশ্চই একমত পোষণ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। তাহলেই কেবল জাতির জনকের ঋণ পরিশোধ হবে। (চলবে) (লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)।