ঈশ্বরদীর পাকশীতে ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ সেতুর সন্নিকটে পদ্মা নদী দখল করে পাহাড় সমান বালুর স্তুপ জমিয়ে রমরমা বালুর ব্যবসা চলছে। ভরা মৌসুমে বালু স্তুপের কারণে একসময়ের ভয়াল পদ্মা নদীর গতিপথই পরিবর্তন হয়ে গেছে। হার্ডিঞ্জ সেতুর নিরাপদ দুরত্বের মাঝে ‘চুপেচাপে’ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে সেতু ও গাইড ব্যাংকের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখিন হয়ে পড়েছে। সরেজমিনে শনিবার পাকশীতে হার্ডিঞ্জ সেতুর পাশে পদ্মা নদীর পারে এই চিত্র দেখা গেছে।
বর্ষার ভরা মৌসুমে পদ্মার তীব্র স্রোত উপেক্ষা করে নদী হতে বালু উত্তোলন, পাহারসম বালু মজুদ করায় নদীর স্বাভাবিক গতিরোধ করে বানিজ্যে মেতে উঠেছেন প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা। পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও পাকশী ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস এই বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রক। এলাকার ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে এলাকাবাসী ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, পদ্মা নদীর এই বিশাল এলাকা লীজ না নিয়ে লীজ গ্রহীতা কৃষকদের নিকট থেকে ভাড়া নিয়ে সেখানে বালুর ব্যবসা চলছে। তবে, পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম জানান, বালুর ব্যবসার সাথে ইউপি চেয়ারম্যান ছাড়া আওয়ামী লীগের আর কোন নেতার সম্পর্ক নেই। চেয়ারম্যান একাই বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। রেল সূত্র এবং স্থানীয়রা জানান, রেলের লীজ নেয়া কৃষি জমিতে বানিজ্যিক ভাবেই চলছে বালুর রমরমা ব্যবসা। পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনাম বিশ্বাসের আত্মিয় স্বজন প্রতিদিন টাকা উঠানোসহ যাবতীয় কর্মকান্ডে দায়িত্ব পালন করেন।
পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের একাধিক নেতা জানান, ইউপি নির্বাচনের আগে বালু ব্যবসা পরিচালনার জন্য কয়েকজন দলীয় নেতাদের সমন্বয় ছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি একাই সব বালুমহাল ও বালুর ঘাট নিয়ন্ত্রণ করছেন। আগে বালু বিক্রির টাকার ভাগ পেলেও এখন দলের কেউই ভাগ পাচ্ছেন না।
স্থানীয়রা জানান, শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এবং লালন শাহ সেতুর খুব কাছে থেকে বালু উত্তোলনে ব্রিজ দুটি হুমকির সম্মুখিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া স্বত্বেও বালু উত্তোলন থেমে নেই। বালুর স্তুপ বড় হতে হতে এখন বিশাল স্তুপের আড়ালে ঢাকা পড়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু।
বালুমহালের নেতৃত্বদানকারী পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস বলেন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিকট বালু স্তুপ করা হলেও এখান থেকে বালু উত্তোলন হচ্ছেনা। এই বালু কুষ্টিয়া, আলাইপুর, পাবনাসহ বিভিন্ন ঘাট থেকে নৌকাযোগে আনার পর নৌকার সাথে ড্রেজিং মেশিন লাগিয়ে বালুর মজুদ করা হয়। পরে এখান থেকে বিক্রি করা হয়। এই বালুমহালের বালু ব্যবসায়ীরা জানান, তারা পদ্মা নদীর এসব জমি ভাড়া নিয়ে বালু স্তুপ করে বিক্রি করছেন। তারা আরো জানান, প্রতিদিন ঈশ্বরদীস্থ পদ্মা নদীর ৪টি ঘাটে গড়ে প্রায় ১ হাজার ট্রাক বালু বিক্রি হয়। টাকার হিসেবে এসব ঘাট থেকে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকার বালু বিক্রি হয়। তবে চেয়ারম্যান এনাম বিশ্বাস এই পরিমান ৫-৬’শ ট্রাক বলে দাবি করেছেন।
ট্রাক প্রতি ১০০ টাকা হিসেবে এসব ঘাট ও বালু মহাল থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। চেয়ারম্যান নিজে চাঁদার টাকাও ভাগ করেন বলে জানা গেছে। সরেজমিনে বালুমহালে গিয়ে দেখা যায়, নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে ঘাটে ট্রাক-ট্রাক্টর আসছে। বালু বোঝাইয়ের পর নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে চাঁদার টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে বালু।
রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় সেতু প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্দিষ্ট দুরত্বের কাছাকাছি পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করলে এই ঐতিহাসিক ব্রিজ হুমকির মুখে পড়বে। বালুর ব্যবসা প্রসংগে তিনি বলেন, আমি পাকশীতে নতুন এসেছি, সবকিছু জেনে পরে বিস্তারিত জানাতে পারবো।
পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনাম বিশ্বাস জানান, রেজা নামের একজনের নামে এই বালু মহাল লীজ নেয়া আছে। সেই অনুযায়ী অন্য স্থান থেকে বালু এনে এখানে রেখে বিক্রি করা হয়। পদ্মা নদী তীরের অন্যান্য স্থানে কৃষকদের লীজ নেওয়া জমি ভাড়া নিয়ে বালু বিক্রি করা হয়।
পাকশী বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা নুরুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, পদ্মা নদীর যে স্থানে বালুর পাহাড় সেই জমি রেলওয়ের। স্থানীয় কৃষকরা বাৎসরিক ভিত্তিতে কৃষিকাজের জন্য লীজ নিয়ে এসব জমিতে চাষাবাদ করে থাকেন। তবে এখন সেখানে চাষাবাদের বদলে বালুর ব্যবসা হচ্ছে। রেল কর্তৃপক্ষ এসব জমির কৃষি লীজ বাতিল করে বাণিজ্যিক লীজ প্রদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিহাব রায়হান বলেন, ইতিপূর্বে উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ওই বালু জব্দ করে নিলামের পর বালু বিক্রি করার এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছিল। এখন যদি বালু ব্যবসায়ীরা আবারো বালুর ব্যবসা চলমান রাখেন তাহলে সরেজমিন তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ নেয়া হবে।