দীর্ঘদিন যাবত অযত্ন আর অবহেলায় বেনাপোলের কাগমারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে আছে। গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এলাকার কোমলমতি শিশুরা পড়েছে মহাবিপাকে। গ্রামে আর কোনো স্কুল না থাকায় দীর্ঘ ২কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাদেরকে যেতে হয় গয়ড়া, কাগজপুকুর বা বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানাযায়, এ গ্রামে আর কোনো স্কুল না থাকায় প্রায় ৩ সহস্রাধিক জনবসতির সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক স্থানীয়দের সহযোগিতায় ১৯৯৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা একেএম করম আলীকে সভাপতি মনোনীত করে স্কুলের নামে ১বিঘা জমি ক্রয় করে দেন। স্থাপন করেন কাগমারি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক, মগর আলী, রস্তুম আলী, ইদ্রিস মাস্টার প্রমুখ।
সে সময় মুজিবুল হককে প্রধান শিক্ষক মনোনীত করে ৫জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। অন্যান্যরা হলেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক’র মেয়ে শাহানাজ পারভীন, বৌমা নূরজাহান রেনু একই গ্রামের হোসেন আলী ও জামতলার শাহানাজ খাতুন। প্রথম শ্রেণী হতে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীর ছিল ৩ শতাধিক। ২০০৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের কিছু কূচক্রীমহল মুক্তিযোদ্ধার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি যাতে আর আলোর মুখ না দেখে সেজন্য নতুন ম্যানেজিং কমিটি গঠন করে নিজেদের দখলে ক্ষমতা নেয়। ওই বছরেই বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ করে সেখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। যেখানে এখন গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, জ্বালানী কাঠ ও গোবরের নুড়ি রাখা হয়।
স্থানীয়রা বলেন, সে থেকে অদ্যবধি কাগমারি গ্রামের প্রাইমারি স্কুল পড়–য়া ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য পাঠাতে হয় গয়ড়া, কাগজপুকুর কিংবা বেনাপোল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেদিকেই যাই, দীর্ঘ ২কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো খুবই কস্টসাধ্য হয়ে ওঠে। অনেকে আবার দুর্ঘটনার ভয়ে দূরবর্তী স্কুলে না পাঠিয়ে ঘরের মধ্যেই আগলে রাখে। তাতে বিদ্যা শিক্ষায় ব্যর্থ হয়ে অনেক ছেলেরা বড় হওয়ার সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাচ্ছে। পারাপার করছে অবৈধপন্থায় মাদকসহ কালোবাজারী পণ্য সামগ্রী। যে কারণে স্কুলটি চালু হলে একদিকে যেমন গ্রামের শিক্ষার হার বাড়বে, অপরদিকে দেশের উন্নয়নে আলো জ্বালাবে নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত সমাজ।
কথা হয় কাগমারি প্রাইমারি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক’র সাথে। তিনি জানান, পাকিস্তানিদের নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সেদিন অস্ত্র ধরেছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম দেশ স্বাধীন করে ফিরব। একটি লাল সবুজের পতাকা অর্জন করেছিলাম। সেদিন স্বপ্ন এঁকেছিলাম, গ্রাম থেকেই শিক্ষার আলো জ্বেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাংলাদেশকে আলোকিত করতে হবে। তাই, দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমার নিজ জন্মস্থান বেনাপোল পোর্ট থানার কাগমারি গ্রামে ১ বিঘা জমি ক্রয় করে সেখানে কাগমারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করি। স্কুলটি ১৯৯৬ সালে ৫জন শিক্ষক-শিক্ষিকা আর ৩শ’ কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল।
এ সময় তিনি আরো বলেন, স্কুলটি বেশ ভালোই চলছিল। এলাকার ছোট্ট সোনামনিরা দৌড়-ঝাপ করে স্কুলে যাতায়াত করত। বেশ ভালো লাগত। ঠিক ২০০৩ সাল, বিএনপির শাসনামল চলছিল। সে সময়ে পুরাতন ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিকে ভেঙ্গে নতুন পরিচালনা কমিটি গঠণ করা হয়। যার নেতৃত্বে আসল বিএনপি নেতা আছের আলী, জব্বার, গফফার, মধুগাজী, ছাত্তারসহ একটি সংঘবদ্ধ দল। পরে অজ্ঞাত কারণে তারা স্কুল বন্ধ করে দিলো। যা অদ্যবধি আর আলোর মুখ দেখেনি।
এক পর্যাযে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক আরো বলেন, দেশ স্বাধীনের পর সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। চাকুরিরত অবস্থায় খুব কষ্ট করে সংসার-ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, ভরণ-পোষণ চালানোর পাশাপাশি বেতনের সিংহভাগ টাকা সঞ্চয় করে উক্ত স্কুলটির জমি ক্রয় করে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এখন মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। তাই, বারংবার মনে পড়ে এলাকার ছোট্র সোনামনিদের কথা। ভাবতেই অবাক লাগে স্কুলটি বন্ধ থাকবে? দু’চোখ বেয়ে পানি আসে। ভাবি, আমার শেষ নিশ্বাষের আগে স্কুলটি চালু হবে? কেউ কি আছেন এখানে বাতি জ্বালবার? পরিশেষে বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে স্কুলটির চালুকরণ অত্যাবশ্যক এবং সরকারের কাছে তিনি মিনতি করেন “কাগমারি স্কুলটির” পূর্ণজীবন দান করার।
স্থানীয় সূত্রে জানাযায়, সম্ভবত: ২০১৪ সাল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাগমারি গ্রামে বিদ্যুতায়নের উদ্বোধন করতে আসেন যশোর-১ (শার্শা) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ শেখ আফিল উদ্দিন। এ সময় তার উন্নয়নের দু’চোখে পড়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা কাগমারি বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে। খোঁজ-খবর নেন এবং স্কুলটি পুনরায় চালু করার পরামর্শ দেন। সাথে শ্রেণী কক্ষ উন্নয়নের লক্ষ্যে ২লাখ টাকা অনুদান দেন। তা দিয়ে স্কুলের আনুসাঙ্গিক কিছু কাজ হলেও এ পর্যন্ত স্কুলটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্কুলটির একাংশে স্থানীয়রা ছাগল-গরু বেঁধে রাখছেন। ঢোকার কোন পরিবেশ নেই। রাখা আছে গোবরের নুড়ি, জ্বালানী কাঠ, বিচুলী। চালের উপর দেওয়া হয়েছে লাউ-কুমড়ার গাছ। মাজা দুমচে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে স্কুলটি। আরেকটি অংশের বিল্ডিং আধা পাকা হওয়ায় যা এখনই ধুয়ে মুছে স্কুলের কার্যক্রম চালু করা সম্ভব বলে জানালেন এলাকাবাসী। এ সময় এক ছোট্ট শিশু বলে উঠল- সাংবাদিক কাকু! স্কুলটি চালু হবেতো?
এ বিষয়ে কথা হয় শার্শা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ আব্দুর রব’র সাথে। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে বেনাপোলের কাগমারি গ্রামে ১বিঘা জমির উপর একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো এবং স্কুলটি ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে গেছে মর্মে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। এপর্যন্ত কেউ আমাদেরকে জানায়নি। ইতিমধ্যে সরকার সকল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করেছেন। এতোদিনে উক্ত গ্রামের মানুষ আমাদের জানালে হয়তো বা স্কুলটি সরকারি করণের মধ্য দিয়েই চালু হতে পারত।
এ বিষয়ে শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূলক কুমার মন্ডল বলেন, বেনাপোলের কাগমারি গ্রামে নিজস্ব জমির উপর একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে বলে আমাদের জানা ছিলোনা। গ্রামের মানুষ এগিয়ে এলে এতোদিনে স্কুলটি চালু করা সম্ভব ছিলো। এখন আবেদন পেলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারি।
ইতিমধ্যে বেনাপোলের কাগমারি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা শামছুর রহমান ও আরব আলীসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ স্কুলটি পুনরায় চালু করণের লক্ষ্যে বেনাপোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ বজলুর রহমানের সাথে আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা মিলে বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী স্থানীয় সাংসদ আলহাজ শেখ আফিল উদ্দিন’র কাছে গিয়ে আলোচনা করবে।